নোয়াখালী দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার ৭ লাখ লোকের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাওয়া আসার মূল প্রবেশদ্বার হলো চেয়ারম্যান ঘাট। আবার এ ঘাটের পাশে গড়ে উঠেছে দক্ষিণ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মাছের পাইকারি বাজার। মাছ বাজারের পাশে বিশাল সিএনজি স্টেশন এ ঘাটকে আরও ব্যস্তময় করে তুলেছে। যার ফলে ৫ আগস্ট পরবর্তী দখল, পাল্টা দখল, ইজারা নেওয়া, শক্তি প্রদর্শন, জোরপূর্বক মাছ বিক্রি করা সবকিছুতে নৈরাজ্য চরমে পৌঁছেছে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলছে এসব নৈরাজ্য। যদিও প্রশাসন একাধিকবার অভিযান চালিয়েছে। এসব অভিযানে কয়েকজনকে আটক করলেও থেমে নেই সেই নৈরাজ্য।
চেয়ারম্যানঘাট মূলত হাতিয়ার মূল ভূখণ্ডের বাহিরে নদীর ওপারে। এটি হরনী ইউনিয়নের অংশ। এজন্য এ ঘাটটি নিয়ন্ত্রণ প্রথম থেকে হরনী ইউনিয়ন বিএনপির হাতে ছিল। হরনী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আক্তারুজ্জামান দোলন ও সাধারণ সম্পাদক এহসানুল হক জুয়েল মূলত এ ঘাট নিয়ন্ত্রণ করছেন। এজন্য তারা বিশাল সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। এই সিন্ডিকেট মূলত ৫ আগস্টের পর থেকে মাছ বাজার, নদীতে যাত্রী পারাপার ও সিএনজি স্টেশন দখল করে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে তাদের নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ করছেন আর পোস্ট দিচ্ছেন।
ইলিয়াছ হোসেন ইসমাইল হাতিয়া উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক হলেও তিনি একজন মৎস্য ব্যবসায়ী। সম্প্রতি এ সিন্ডিকেট তার দাদন দেওয়া ট্রলারের মাছ জোরপূর্বক বিক্রি করে দেওয়ায় দলের মধ্যে সমালোচনার ঝড় উঠে।
ইলিয়াস হোসেন ইসমাইল বলেন, হাতিয়া চেয়ারম্যান ঘাটটি এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় পাইকারি মাছের বাজার। সম্প্রতি এ বাজারটি দখল করে সাধারণ ব্যবসায়ীদের মাছ বিক্রি করে কমিশন ভাগিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এজন্য বিএনপি নেতা দোলন, ইমাম হাসান ও জুয়েলের নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছে। এদের অনেকে মাছ ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত নয় কিন্তু তারা এখন মাছ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। এরা ফ্যাসিস্ট আমলের সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরা আত্মগোপনে থাকায় তাদের আড়ত দখল করে বর্তমানে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এরা এখন অনেকটা বেপরোয়া। আমি উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক। অথচ তারা আমার দাদন দেওয়া ট্রলারের মাছ জোরপূর্বক নিয়ে বিক্রি করে দেন। প্রায় ১৭ লাখ টাকা মাছ বিক্রির কমিশনও ভাগিয়ে নেন তারা। মাছ বাজার নিয়ে তাদের এ অপকর্মের বিষয়ে বিএনপির জেলা ও বিভাগীয় নেতৃবৃন্দকে বলা হয়েছে।
ইসমাইল আরও বলেন, চেয়ারম্যান ঘাটের মাছ বাজার, যাত্রী পারাপার ও সিএনজি স্টেশন নিয়ন্ত্রণ করছে এই সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট এ ঘাটকে কেন্দ্র করে বিশাল নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি তারা সহযোগী সংগঠনের ১৩ জনকে নিয়ে একটি সম্মিলিত কমিটি গঠন করেছে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি দোলন ও সাধারণ সম্পাদক জুয়েল।
এ বিষয়ে কথা হয় ট্রলারের মালিক মুজাম্মেল হাজীর সঙ্গে। তিনি জানান, গত ২২ এপ্রিল সোমবার তার মালিকানা ট্রলারটি মাছ নিয়ে ঘাটে আসে। ট্রলারের জেলেরা তাদের নির্ধারিত আড়তে মাছ বিক্রি করতে চাইলে বাধা দেয় সিন্ডিকেটের লোকজন। তারা জোরপূর্বক ট্রলার থেকে মাছ নিয়ে তাদের মতো করে বিক্রি করে ফেলে। পরে মাছের টাকা দিলেও কমিশন ভাগিয়ে নেয় তারা। এই বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।
স্থানীয়রা জানান, গত ৫ আগস্টের পর চেয়ারম্যান ঘাটের যাত্রী পারাপারের ইজারাদারের লোকজনকে তাড়িয়ে দিয়ে ঘাট দখল করে নেন ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি দোলন। তিনি তার লোকজনকে দিয়ে দীর্ঘদিন এ ঘাট জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন।
চেয়ারম্যান ঘাটের ইজারাদার গোলাম মাওলা কাজলের প্রতিনিধি ফাহিম উদ্দিন বলেন, বার বার চেষ্টা করেও দোলনের সঙ্গে সমঝোতা করা যায়নি। ঘাট থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তিনি ঘাট নিয়ন্ত্রণ করছেন। দীর্ঘ ৬ থেকে ৭ মাস তিনি এই ঘাট দখল করে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। প্রশাসনের অনেকের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে। কোন লাভ হয়নি।
সম্প্রতি হাতিয়া উপজেলা প্রশাসন হাতিয়ার ৩৯টি হাটবাজার ইজারা দেয়। যার মধ্যে চেয়ারম্যানঘাট বাজার একটি। চেয়ারম্যান ঘাট কেন্দ্রীক গড়ে উঠা এই সিন্ডিকেট রিয়াজ উদ্দিন নামে একজনকে দিয়ে চেয়ারম্যান ঘাট বাজারটি ইজারা নেয়। বাজার ইজারা নিয়ে তারা সিএনজি, বাস-মিনিবাস, প্রাইভেট কার, ট্রাক থেকে টোল আদায় শুরু করেন।
এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ হাতিয়া উপজেলা উত্তর শাখা আনুষ্ঠানিকভাবে এর প্রতিবাদ করে। তারা লিখিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করে।
সংগঠনের সভাপতি আবু যর গিফারী সুমন বলেন, চেয়ারম্যানঘাট বাজারের ইজারাদার রিয়াজ সব ধরনের যানবাহন ও পরিবহন থেকে টোলের নামে চাঁদা আদায় করছেন। এর ফলে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ যাত্রীদের অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হচ্ছে। টোলের ভয়ে এখন এ দিকে যাত্রীবাহী গাড়ির পরিমাণ কমে যাওয়ায় জনসাধারণ চরম ভোগান্তিতে পড়ছে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী শামীম বলেন, চেয়ারম্যান ঘাট বাজারে আসা ট্রাক, সিএনজিসহ বিভিন্ন যাত্রী পরিবহন থেকে অবৈধভাবে টোল আদায়ের বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। আমরা এ বিষয়ে চেয়ারম্যান ঘাট বাজারের ইজারাদারকে সতর্ক করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আক্তারুজ্জামান দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মাছ বিক্রির বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমি ছেলেদেরকে ইসমাইলের গদির মাছ বিক্রি করতে নিষেধ করেছি তবুও তারা বিক্রি করে ফেলেছে। এতে যে কমিশন এসেছে তা ইসমাইলকে ফেরত দিতে বলে বিষয়টি মীমাংসা করে দিয়েছি। ঘাট নিয়ন্ত্রণের ৪০ জনের কমিটিতে আমি নেই, ১৩ সদস্যের সম্মিলিত সমন্বয়ক কমিটিতে আছি।
এ ছাড়া যাত্রী পারাপারের ঘাট তার নিয়ন্ত্রণে থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিএনপি নেতাকর্মী বলেন, এ সকল অনিয়মের কারণে দোলনকে জেলাতে ডেকে নিয়ে ভর্ৎসনা করা হয়েছে। তাতেও কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি।
এ বিষয়ে উপজেলা বিএনপির সভাপতি এ কে এম ফজলুল হক খোকন বলেন, দলের নাম ভাঙিয়ে যারা চাঁদাবাজি বা দলবাজি করবে তাদের বিরুদ্ধে দল কঠিন সিদ্ধান্ত নেবে। আমাদের বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশ, যারা দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে তাদেরকে ছাড় দেওয়া হবেনা।
আরটিভি/এমকে