ঢাকামঙ্গলবার, ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১৮ চৈত্র ১৪৩১

বিমানের ভাড়া কারসাজিতে ১১ এয়ারলাইনস

আরটিভি নিউজ

শনিবার, ২৯ মার্চ ২০২৫ , ০৫:৫৩ পিএম


loading/img
ফাইল ছবি

ব্যবসায়িক কাজে চলতি সপ্তাহেই সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে যেতে হবে। কিন্তু টিকিট কিনতে গিয়েই চোখ কপালে। গত নভেম্বরে যেখানে ঢাকা থেকে রিয়াদগামী জাজিরা এয়ারলাইনসের জনপ্রতি ভাড়া ছিল ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা, তা ফেব্রুয়ারিতে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার টাকায়। একইভাবে ঢাকা-জেদ্দা-মদিনা-ঢাকা পথে যাওয়া-আসায় নভেম্বরে যে টিকিট ছিল ৭১ হাজার ৩৪০ টাকা, তা চলতি মার্চে কিনতে হচ্ছে ১ লাখ ২৪ হাজার ২৪৫ টাকায়। এমন অবস্থায় চারদিকে যখন আলোচনা, তখন এর কারণ খুঁজতে তদন্তে নেমে সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব নাসিমুল গনির নেতৃত্বে ৯ সদস্যের কমিটি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকায় প্রতিবেদনটি তার কার্যালয়েও দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, সৌদিয়া এয়ারলাইনস, এয়ার অ্যারাবিয়া, ফ্লাই দুবাই, সালাম এয়ার, জাজিরা এয়ার, বাটিক এয়ার, এয়ার এশিয়া, গালফ এয়ারসহ ১১ এয়ারলাইনস এই টিকিট জালিয়াতিতে যুক্ত। 

বিজ্ঞাপন

মূলত, এয়ারলাইনসগুলো ট্রাভেল এজেন্সির জন্য ৭ শতাংশ কমিশন রেখে বিমান ভাড়া নির্ধারণ করে। কিন্তু এয়ারলাইনসের নির্ধারিত দামে যাত্রীকে টিকিট না দিয়ে এজেন্সি নিজেদের মতো দর নির্ধারণ করে। কিছু এজেন্সি গ্রুপ বুকিংয়ের নামে প্রকৃত চাহিদার অতিরিক্ত সংখ্যক টিকিট কিনে অন্য এজেন্সির মাধ্যমে বেশি দামে বিক্রি করে। 

এ ছাড়া প্রবাসী কর্মীরা যে রুটে বেশি ভ্রমণ করেন, সেই পথে ফ্লাইট সংখ্যা কম রয়েছে। অনেকে আবার শেষ মুহূর্তে টিকিট কিনে থাকেন। এতে টিকিটের বেশি চাহিদা থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করেন। 

পাশাপাশি আশপাশের দেশের চেয়ে আমাদের এখানে কর ও সারচার্জ, জ্বালানির উচ্চদর এবং ডলারের দামে বড় তারতম্য থাকায় টিকিটের দামে এর প্রভাব পড়ছে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে প্রাথমিকভাবে ৩০ এজেন্সিকে গ্রুপ বুকিংয়ের নামে যাত্রীর পাসপোর্ট ছাড়াই টিকিট ব্লক করার পরে তা উচ্চদরে বিক্রির অভিযোগে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। এসব এজেন্সির মধ্যে যারা ব্লক করা টিকিট বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বিক্রি করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়, এমন ১২ এজেন্সির মালিককে শুনানিতে ডাকা হয়। 

এর মধ্যে কাজী এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, সিটিকম ইন্টারন্যাশনাল, কিং এয়ার এভিয়েশন, আরবিসি ইন্টারন্যাশনাল, মেগা ইন্টারন্যাশনাল, মাদার লাভ এয়ার ট্রাভেলস, জেএস ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস, সাদিয়া ট্রাভেলস, মেসার্স এনএমএসএস ইন্টারন্যাশনাল, হাশেম এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, বিপ্লব ইন্টারন্যাশনাল ও ফোর ট্রিপ লিমিটেড ব্লক করে রাখা টিকিট নিজেরা বা সাব-এজেন্টের মাধ্যমে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করেছে। 

এসব এজেন্সি সৌদিয়া এয়ারলাইনস, ফ্লাই দুবাই, সালাম ও জাজিরা এয়ারের বেশির ভাগ টিকিট বিক্রি করেছে। সৌদিয়া এয়ারলাইনস, সালাম ও জাজিরা এয়ারের জিএসএ হলেন এয়ার গ্যালাক্সি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদ। তিনি কাতার এবং ওমান এয়ারেরও জিএসএ।

অপরদিকে তদন্ত কমিটির কাছে একাধিক এজেন্সির মালিক জানান, গ্রুপ তৈরি করার বিষয়টি এয়ারলাইনসের এখতিয়ার। এয়ারলাইনসগুলোই গ্রুপ তৈরি করে সেই ভিত্তিতে টিকিট কিনতে তাদের উদ্বুদ্ধ করে। এ ছাড়া এজেন্সিগুলো অনেক ক্ষেত্রে সাব-এজেন্ট হিসেবেও কাজ করে। 

বিপরীতে জিএসএদের দাবি, তারা টিকিট বিতরণ ও বিক্রির জন্য ট্রাভেল এজেন্ট নিয়োগ করলেও তাদের দায়দায়িত্ব নেননি।

বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বেসামরিক বিমান চলাচল আইন, ২০১৭-এর অধীন জিএসএ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে কোনো বিধিমালা নেই। তবে বেবিচক জিএসএদের কার্যক্রম তদারকি করতে পারে। এরপরও এখনও কোনো জিএসএর কার্যক্রমে আনুষ্ঠানিক তদারকিতে যুক্ত হয়নি বেবিচক। এমনকি টিকিট ব্লক করে রাখা বা কৃত্রিমভাবে সংকট তৈরি করাকেও অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। 

এদিকে বাংলাদেশ বিমান মোটযাত্রীর মাত্র ২০ শতাংশ পরিবহন করতে পারে। বাকি ৮০ শতাংশ পরিবহন করেন অন্যান্য এয়ারলাইনস। এ সুযোগে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছে এয়ারলাইনস ও এজেন্সিগুলো।

অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ বলেন, বিশ্বের কোনো দেশে জিএসএ বাধ্যতামূলক করা নেই। তবে ২০১৭ সালে আইন সংশোধন করে বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কারণ, আওয়ামী লীগ সরকার চেয়েছিল, তাদের দলীয় কিছু ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকবে এ ব্যবসা। এর পর থেকে বাংলাদেশে টিকিট জালিয়াতি বাড়ে।

আটাবের সাধারণ সম্পাদক আফসিয়া জান্নাত সালেহ বলেন, এয়ারলাইনসগুলো সব এজেন্সিকে টিকিট বিক্রির অনুমতি দেয় না। তাদের পছন্দের এজেন্সিকে টিকিট বিক্রির অনুমতি দেয়। অনেক এজেন্সি ব্যাংক গ্যারান্টি দেওয়ার পরও টিকিটিং অথরিটি পায় না। 

তিনি আরও বলেন, এয়ারলাইনসগুলো সব এজেন্সির জন্য টিকিট উন্মুক্ত করে না বলে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। 

অভিযোগকে পাশ কাটিয়ে সৌদিয়া এয়ারলাইনসের জিএসএ ও গ্যালাক্সি লিমিটেডের এমডি আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদ বলেন, কিছু ট্রাভেল এজেন্ট সুযোগ বুঝে লাভ করতে পারে। তবে এয়ারলাইনসগুলো স্বচ্ছ উপায়ে টিকিট বিক্রি করেছে। গ্রুপ বুকিংয়ের নিয়ম সারাবিশ্বে রয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিমান টিকিটের ভাড়া ডলারে একই রয়েছে। কিন্তু টাকাতে সেটা ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের কর ও ফি বেড়েছে। 

মেগা ইন্টারন্যাশনালের অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার রাসেল বলেন, আমরা সালাম এয়ার, এয়ার অ্যারাবিয়া ও কাতার এয়ারের বেশির ভাগ টিকিট বিক্রি করি। এসব টিকিট আগে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমেও বিক্রি করা হতো। কিন্তু ১১ ফেব্রুয়ারি টিকেটের চড়া দাম রোধে বিমান মন্ত্রণালয় থেকে একটি পরিপত্র জারির পর থেকে গ্রাহকের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এয়ারলাইনসের সঙ্গে যোগাযোগ করে টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব নাসিমুল গনি গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যারা যান, তাদের টিকিটের দাম অনেক বেশি পড়ে। এ বিষয়ে আইন আছে, বিধি আছে। কিছু প্রতিপালন হচ্ছে, কিছু হচ্ছে না। 

তিনি আরও বলেন, কিছু কিছু মানুষের দুর্বৃত্তপনা আছে। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে উত্তরণের জন্য কিছু সুপারিশ করেছি। 

এর আগে, গত ১১ ফেব্রুয়ারি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। একই দিনে টিকিটের চড়া দাম রোধে সার্বক্ষণিক তদারকির জন্য ১৪ সদস্যের একটি টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়।
 
তার আগে, গত ২৬ জানুয়ারি টিকিটের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি ও মজুদদারি বন্ধের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করে আটাব। সংগঠনটির দাবি, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান পরিবহন খাতের বড় সমস্যা টিকিটের অতিরিক্ত দাম। এর প্রধান কারণ, একসঙ্গে অনেক নাম ছাড়া টিকিট বুকিং দিয়ে রাখা। 

আরটিভি/আইএম

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন

Loading...


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |