নির্বাচনী সংস্কৃতির চিরন্তন পাঠটি সুখকর না

রায়হান উল্লাহ

বুধবার, ২৭ মার্চ ২০২৪ , ১০:১৪ পিএম


নির্বাচনী সংস্কৃতির চিরন্তন পাঠটি সুখকর না
রায়হান উল্লাহ। ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে নির্বাচন একটি মজার ও ভয়ানক বিষয়; অনেকক্ষেত্রে তা উৎসবেরও। দেশের ৫৩ বছরের কাঠামো প্রথম দুটি বিষয়ের জন্য দায়ী। তৃতীয় বিষয়টির জন্য বাঙালির যেকোনো কাজকে উৎসবে রূপান্তর করার প্রয়াস কারণ। এ দেশে নির্বাচন কোনো সময়েই সঠিক হবে ধরা যায় না। এর পেছনে নানা কারণ জড়িত। নির্বাচন যেকোনোভাবেই জিতে আসার মানসিকতা এ দেশের প্রায় সবার মাঝেই আছে। এ থেকেই নির্বাচন বিষয়টি ভয়ের সৃষ্টি করে। মানুষের মৃত্যুও হয় এ নির্বাচনকে ঘিরে। সব ছাপিয়ে নির্বাচন মানেই উৎসবের বিষয়। উৎসব খুব বেশি পায় না এ দেশের মানুষ। ফলে নির্বাচন অবশ্যই ভিন্ন আমেজ সৃষ্টি করে। এ থেকেই উৎসবের জন্ম। 

উৎসব হওয়ার নানা কারণ আছে। যেকোনো নির্বাচনে এ দেশে প্রার্থীকে অনেক অর্থ খরচ করতে হয়। যদিও তা হওয়ার কথা ছিল না। তিনি দাঁড়িয়েছেন এ প্রচার সংশ্লিষ্ট সবাই অর্থাৎ ভোটারের কাছে পৌঁছালেই হতো। এ বার্তাটুকু পৌঁছার জন্য অঢেল অর্থ খরচ করতে হয় না। যদিও বাস্তবতা ভিন্ন। যেকোনো নির্বাচনে এ দেশে প্রার্থীকে একটি বড় অংকের অর্থ খরচ করতে হবে ধরে নিয়েই মাঠে নামেন তিনি। ফলে অর্থ চারপাশে বিলি করেন প্রার্থী। অনেকেই তা পান এবং দেদার খরচ করেন। অনৈতিক অর্থ খরচ হয় বলেই নিবাচন উৎসবের রূপ নেয়। ভোট কেনাবেচাও হয়। ফলে একটি উৎসব ভাব বিরাজ করে।   

বিজ্ঞাপন

আরেকটি বিষয় আমাদের দেশে নির্বাচনে প্রভাব ফেলে। আপনার অবশ্যই পেশিশক্তি থাকতে হবে। অর্থাৎ নির্বাচন ‘সুষ্ঠুভাবে’ শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল থাকতে হবে। না হয় যত যোগ্য ও সৎই হন না কেন নির্বাচনের ফলাফল আপনার পক্ষে আসবে না। নির্বাচনে আরেকটি বিষয় কাজ করে কেন্দ্র দখল করে ফেলা। পরে একের পর এক ব্যালট পেপারে সিল মারা। 

শুরুর প্রসঙ্গে ফেরা যেতে পারে। নির্বাচন মজার এসব নিয়েই। যেকোনো নির্বাচনে যতজন প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন; তাদের মাঝে একজন ভোটার যাকে যোগ্য মনে করবেন তাকে ভোট দিবেন এই তো সহজ ও সাধারণ বিষয়। কিন্তু এসবের মাঝে অনেক বিচ্যুতি ও অনিয়ম ঢুকে পড়ার ফলে পুরো বিষয়টির মজার মানে হাসি-তামাশার হয়ে দাঁড়ায়। শুধুই সৎ কিংবা যোগ্য হয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারবেন না আপনি। তার জন্য অনেককিছু লাগবে। এসবের কারণেই নির্বাচন হয়ে দাঁড়ায় ভয়ের। আর খুব বেশি অর্থের ওড়াউড়ি ওই সময়টাই হয় বলে তা উৎসবের আমেজ পায়। আর তা যদি স্বাভাবিক রূপ পেত তবু উৎসব হতো। পরের উৎসবটি সুস্থ হতো। একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় একজন সৎ ও যোগ্য প্রতিনিধি মিলবে। তিনি যে শাখার প্রতিনিধি হয়েছেন সে শাখাটিতে ক্রমশ নিজের কারিশমা দেখাবেন; এ ভিন্ন উৎসব। কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যায় অন্য উৎসব। অঢেল অর্থ ওড়ে নির্বাচনে। তরুণ-যুবকরা পরিবার ছাড়াও ভিন্নভাবে অর্থ পান। যা খরচ করতে কখনোই তাদের জবাবদিহি করতে হয় না। ফলে তাদের অন্যায় পথে পা বাড়াতে দেখা যায়। আর এমন নির্বাচনের ফসল একজন অযোগ্য প্রতিনিধি যিনি যেকোনোভাবে পাস করেছেন; অন্যায়ভাবে এর সুবিধা নেবেন বলে। আমাদের দেশে চারপাশে এমন নির্বাচন দেখছি কিনা? নির্দিষ্ট করে কোনো নির্বাচনকে ইঙ্গিত না করে পাঠকের দৃষ্ঠিকে একটু গভীরে নেওয়ার অনুরোধ করছি। চারপাশের অসংখ্য নির্বাচন এমন উদাহরণ সৃষ্টি করছে কিনা? 

একটু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণে কিছু চিত্র তুলে ধরব। তাতে নির্বাচনের বাংলাদেশের সংস্কৃতির কিছু পাঠ পাওয়া যেতে পারে। আমার জন্ম একটি গ্রামে। সেখানেই কেটেছে আমার বালকবেলা-কৈশোরকাল। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পাড়ার ‘মেম্বার’ প্রার্থীর জন্য মিছিল করেছি। মিছিল যত বড় তার জনপ্রিয়তা তত বেশি এমন ভাবনা ভোটারের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া ছিল উদ্দেশ্য। তার সুফল বাংলাদেশে সব নির্বাচনেই মেলে। ঘুরেফিরে নির্বাচন মানেই ‘শোডাউনের’ বিষয়। নির্বাচনকালীন প্রার্থীর বাড়িতে সারাক্ষণ খাবার ও চায়ের ব্যবস্থা থাকত। প্রার্থীর হয়ে ‘মাইকিংয়ের’ শব্দে মুখর থাকত এলাকা। রাতে বাড়ি বাড়ি পোস্টার সাটানো হতো। এ পোস্টার পাওয়ার জন্য প্রার্থীর বাড়িতেও যেতাম। পোস্টারের উপর পোস্টার সাটানোয় জগড়া লাগতেও দেখেছি। বড় ভাইয়ের কল্যাণে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীর নানা উপহার সরঞ্জাম বাড়িতে আসত। তার মাঝে থাকত অনেককিছু। 

বাবা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ায় ওই সময়টিতে বিভিন্ন নির্বাচনের প্রিসাইডিং অফিসার হতেন। তিনিই কেন্দ্রের প্রধান। তার জন্য উৎকণ্ঠাও হতো। অনোচনীয় কালি পেতাম তার জন্য। নিজেও সাহস নিয়ে নানা নির্বাচনী কেন্দ্রে ঢু মারতাম বালক হয়েও। দেখেছি কেন্দ্র দখল। অসংখ্য যুবক হন্যে হয়ে ব্যালটের পর ব্যালট সিল মারতে দেখেছি। তখন অনেকের উৎকণ্ঠা দেখেছি এই বুঝি ম্যাজিস্ট্রেট আসল, এই বুঝি সেনাবাহিনী আসল। গোলযোগ হলে তাদেরকেই ভয় পেত সংশ্লিষ্টরা। 

বিজ্ঞাপন

আমার আপন বড় কাকা দুটি সংসদ নির্বাচন করেছেন। এ থেকেও নির্বাচনের বাংলাদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক বেশি ধারণা জন্মেছে। মাকে দেখেছি মানুষের সেবা-যত্ন করতে। বাবা ‘নির্বাচনী খরচ’ চারপাশে বিলাতেন। সৎ হওয়ার পরও তাকে এটি করতে হতো; অনিচ্ছা সত্বেও। এমনও দেখেছি যিনি প্রতিদিন আমাাদের কাছ থেকে নির্বাচনী খরচ নিতেন তিনিই কিনা অন্য প্রার্থীর হয়ে গেছেন ভোটের সকালে। 
একটি সংসদ নির্বাচনে ভোটের সকালে কেন্দ্রে পোস্টার লাগাতে গেছি। পুরো কেন্দ্র পোস্টারে ছেয়ে আছে এর মাঝেই একজন পুলিশ বললেন এখানে পোস্টার লাগানো যাবে না। বালক আমার মেজাজ চরম বিগড়ে উঠল। বললাম সব পোস্টার আগে তুলেন; তারপর না হয় লাগাব না। তিনি অন্য একজনের কাছে আমার পরিচয় জানলেন। পাবিারিক পরিচয় পেয়ে বুঝলেন এ সহজ বালক না। 

তখন আমার বয়স পাঁচ কি ছয়। সবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। গ্রামীণ কিশোর পুলিশ দেখলেই ভয় পাওয়ার কথা। নির্বাচন মানেই কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে পুলিশ আসবে। সচরাচর ওই সময়টি মানে আশির দশকে গ্রামে পুলিশ মানেই ভয়ের কিছু। ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ঘুরছি। নির্বাচন মানেই স্কুল বন্ধ। খোলা থাকবে কীভাবে স্কুলই যে কেন্দ্র। তো কাজহীন আমি আর কী করতে পারি? আর এ দিনে অন্য কিছু করাতে অ্যাডভেঞ্চার কই? নির্বাচনই তো বেশি অ্যাডভেঞ্চারের বিষয়। এই বুঝি মারামারি লেগে গেল। বালকের কাছে মারামারির চেয়ে বেশি অ্যাডভেঞ্চার আর কী হতে পারে? তো ঘুরছি; এমন সময় কেন্দ্রে দায়িত্বরত একজন পুলিশ সদস্য আমাকে ডাকলেন। আবারো বলছি আমার বয়স পাঁচ কি ছয়। পুলিশ ডাকলে ভয়ে দৌড়ে পালানোর কথা। আমি এগিয়ে গেলাম। সঙ্গিরা ভাবলেন এই বুঝি ‘থাবড়া’ খাব। তিনি আমাকে বাবার নাম জিজ্ঞেস করলেন। জানালেন তিনি বাবার ছাত্র। আমাকে আদর করে সত্যিকার বুলেট দেখালেন। আমি শিউড়ে উঠলাম। শেষে বললেন- স্যারকে সালাম দিবা। আমি তোমাদের বাসায় এসে পড়েছি। আমাকে কিছু টাকা দিলেন। আমি তৎক্ষণাত তা দিয়ে লোভনীয় খাবার কিনে ফেললাম। এমন অসংখ্য সুখ-দুঃখের স্মৃতি আছে নির্বাচন নিয়ে। 

একটি দুঃখের স্মৃতি বলতে পারি। অজ পাড়াগাঁয়ে যেকোনো একটি নির্বাচনে বাবা গেছেন প্রিসাইডিং অফিসার হয়ে। ভোট শেষে ব্যালট বক্স নিয়ে ফিরছেন। অল্প পুলিশ ও আনসার সদস্য থাকায় বা তাদের গাফিলতিতে বাবার হাতে ব্যালট বক্সের একটি ছিল। ছাত্র পরিচয় দিয়ে এক যুবক এসে বললেন স্যার এটি আমাকে দিন। আপনি কেন কষ্ট করবেন। বলে রাখা ভালো আমার বাবা এখনো বদ্ধমূল বিশ্বাস নিয়ে আছেন কোনো ছাত্র তার ক্ষতি কোনোকালে করতে পারে না। তার বিশ্বাস ঠিকই আছে। ওই যুবকটি ছাত্রের ভান ধরেছে। ফলাফল বাক্সসহ সে উধাও। এবং বাবাকে নিয়মরক্ষার খাতিরে একরাত থানায় থাকতে হয়েছে। খুব ছোটবেলায় কিছু না বুঝলেও এটুকু বুঝেছি কোথাও কোনো সমস্যা হয়েছে। পরিবারের সবাই উদ্বিগ্ন। এবং দিনের আলো ফোটায় তিনি বাড়িতে আসলেন। তাকে স্বর্ণ-রূপার পানিতে গোছল করানোর পরে ঘরে ঢুকানো হলো। 

আরেকটি ক্ষুদ্র কষ্টের কথা। বাবার ব্যাগে থাকা নির্বাচনের অমোচনীয় কালি হাতে মাখলে উপকার পাব এমনটি জানালেন আপন চাচাত এক বড় ভাই। আমি তাই করলাম। পাঠক বাকি কষ্টটা ধরার চেষ্টা করুন। 
এখন এই একবিংশ শতাব্দীতে বাড়ির বাইরে থাকি। রাজধানীতে থেকে নির্বাচন খুব বেশি টানে না। নির্বাচনে অন্য অনেক নাগরিকের মতো আমারো ঘৃণা জন্মেছে। একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে বিগত অনেক নির্বাচনে ‘প্রেস কার্ড’ নিয়ে গিয়েছি। যা দেখেছি তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। এ দেশের নির্বাচনের উৎসব আমেজ ফিঁকে হয়ে গেছে। নির্বাচন হয়ে গেছে জোয়ার বোর্ড। তার দেখভাল করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এবং ক্ষমাতাসীন দলের ক্যাডাররা। এসব বলা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

ইদানিং সাংবাদিক সংগঠনের অনেক নির্বাচনে থেকেছি উপকারি কিছু মানুষ প্রার্থী হওয়ায়। দেখেছি নির্বাচন মানেই একটি দুষ্ট খেলা। বিরুদ্ধ গোষ্ঠী প্রার্থীর গায়ে অপবাদ দিয়ে বেড়ায়। এতে লাভও হয়। আরো দেখেছি সৎ ও যোগ্য হওয়া আর নির্বাচনে জেতা এক জিনিস না। নির্বাচন মানেই ভিন্ন বিষয়। নানাভাবে ভোট জোগার করতে হবে আপনাকে। অর্থ কিংবা পেশির বলে। এবং আরো অনেককিছু থাকতে হবে। 

সব মিলিয়ে এ দেশে নির্বাচনী সংস্কৃতির চিরন্তন পাঠটি সুখকর না। যেকোনো নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা কমিশনও সৎ ও শক্তিশালি না। ফলে উৎসব আমেজ না ছড়িয়ে এ দেশের নির্বাচন তামাশা ও ভয় ছড়ায়। আগেই অনেকে জেনে যায় কী হচ্ছে। তারা উদযাপনও করে ফেলে ভুলে-বেভুলে। কী বলা কিংবা ভাবা যায় নতুন করে? এ যে রঙ্গে ভরা বঙ্গদেশ। প্রতিটি স্তরের নির্বাচন এমনটি বলে! 

লেখক : কবি ও সাংবাদিক।

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

Loading...


© All Rights Reserved 2016-2025 | RTV Online | It is illegal to use contents, pictures, and videos of this website without authority's permission | powered by TechnoNext Software Limited.