ঢাকাWednesday, 28 May 2025, 14 Jyoishţho 1432

প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিমের মৃত্যু যেন এক নক্ষত্রের পতন

এম এম ইমরুল কায়েস

রোববার, ৩১ মার্চ ২০২৪ , ০৭:৫৬ পিএম


loading/img

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগদান করেছি দু’দিন হলো মাত্র; আমার রিপোর্টিং বস প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব স্যারের সঙ্গে পরিচয়ের পর খুব ফর্মাল কিছু কথাবার্তা হয়েছে। অফিসে কাজ করছি এমন সময় স্যারের টেলিফোন। রাশভারী কণ্ঠস্বর, ‘ইমরুল, তুমি কি অফিসে?’ তটস্থ হয়ে উত্তরে বললাম, ‘ইয়েস স্যার।’ আবার সেই মায়াবী কণ্ঠ, ‘তোমার গাড়ি কি অফিসে আছে?’ আমার প্রত্যুত্তর, ‘ইয়েস স্যার।’ স্যারের আবারও প্রশ্ন, ‘তুমি কি এখন বাইরে কোথাও যাবে?’ আমার উত্তর, ‘নো, স্যার।’ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে স্যার আমাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার ভাবি দেশের বাইরে থেকে কিছুক্ষণের মধ্যে এয়ারপোর্টে নামবে; তোমার গাড়িটি কি একটু পাঠাতে পারবে?’ ক্যাডার সার্ভিসের অফিসার হিসেবে বসের সার্বক্ষণিক নির্দেশ পালন করতেই অভ্যস্ত আমরা; এ পরিস্থিতিতে স্যারের ভদ্রতা পরম মুগ্ধতায় গ্রাস করল আমাকে। এভাবেই প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম হেলাল স্যারের সঙ্গে আমার পথ চলা শুরু।

বিজ্ঞাপন

১০ মার্চ। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে প্রেস সচিব স্যারের মিসেস আমাকে ফোন করে জানালেন, স্যারের শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক। ভাবির কণ্ঠস্বর আমাকে উতলা না করে পারল না। আবার মনে মনে এটাও ভাবছিলাম-স্যার তো গ্রেট ফাইটার, বারবার নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে তিনি ফিরে এসেছেন, এবারও নিশ্চয়ই আমাদের হতাশ করবেন না। কিন্তু রাত ৮টার দিকে বাস্তবিকভাবেই সেই নির্মম সংবাদটা পেলাম! টানা ২ মাস ১০ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে আমাদের প্রিয় স্যার ইহসানুল করিম হেলাল মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি অবিশ্বাস করার জন্য বারবার জিজ্ঞেস করছিলাম, ডাক্তাররা কনফার্ম করেছে কিনা। নিরুপায় হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানালাম। নিঠুর হৃদয়ে অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে প্রধানমন্ত্রীর শোক বার্তাটি টাইপ করা শুরু করলাম। দু’চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল, কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছিলাম না! হন্তদন্ত হয়ে ছুটলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে।

দীর্ঘ প্রায় ৫২ বছরের বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার। ছিলেন রাষ্ট্রের প্রধান দুই ব্যক্তি মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উভয়েরই প্রেস সচিব। তার আপন চাচা জাওয়াদুল করিমও ছিলেন ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব। ১৯৭২ এ যে প্রতিষ্ঠানে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন, সেই বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান হন ২০০৯ সালে। তিনি ভারতের নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ব্যুরো চিফ ছিলেন। বিবিসি, জাতিসংঘ, ওআইসি এবং কমনওয়েলথসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করেছেন। ভারতীয় পত্রিকা দি স্টেটসম্যান, ইন্ডিয়া টুডে এবং প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া নিউজ এজেন্সিতে কাজ করেছেন। এছাড়া ইহসানুল করিম অস্ট্রেলিয়ার সিডনি মর্নিং হেরাল্ড এবং বেলারোট কুরিয়ার পত্রিকায়ও কাজ করেন।

বিজ্ঞাপন

ইহসানুল করিম পড়াশোনা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভারতের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব নিউজ এজেন্সি জার্নালিজম এর ডিগ্রি নিয়েছেন, সেখানে পেয়েছেন বেস্ট অ্যাওয়ার্ড। কমনওয়েলথ প্রেস ইউনিয়নের বৃত্তি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায়ও পড়ালেখা করেন তিনি। ১৯৬৭ সালে তিনি তৎকালীন কুষ্টিয়া সদর মহকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। আমাদের জীবনের মহোত্তম অর্জন বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবিসংবাদিত নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়; সেই স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

দীর্ঘ ৮ বছর ৩ মাস স্যারের সঙ্গে কাজ করেছি আমি। তিনি ছিলেন আমার ডাইরেক্ট বস, অথচ কোনদিন ঘুণাক্ষরেও বসিং অনুভব করিনি। আমার পিতার চেয়ে বছর কয়েকের বড় হয়েও তিনি আমাদের সঙ্গে মিশেছেন বন্ধুর মতো অথচ কাজকর্মে ছিলেন দায়িত্বশীল। প্রেস ম্যাটারগুলি বুঝিয়ে দিতেন সহজ সাবলীলভাবে। আমাদের ভুলত্রুটি নির্দ্বিধায় শোল্ডারিং করতেন পরম মমতায়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ, চরম পরোপকারী ও প্রচণ্ড ক্ষমাশীল একজন মানুষ। আমার নিজের চোখে দেখা, স্যারকে নিয়ে কটূক্তি করা কিংবা তার অমঙ্গল কামনা করা ব্যক্তির জন্যও তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন নির্দ্বিধায়। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস টিমকে নেতৃত্ব দিয়েছেন একজন যোগ্য ও দক্ষ ক্যাপ্টেনের ন্যায়।

দেশে-বিদেশে স্যারের সঙ্গে আমার শত শত স্মৃতি! কোনটা রেখে কোনটা বলি! অফিসে প্রায়ই তিনি আমার রুমে আসতেন; তার বিশাল অভিজ্ঞতার গল্প শুনাতেন। কতবার বলেছি, স্যার আপনার এই বিরল অভিজ্ঞতাগুলি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিখে রেখে যান। ছাত্র জীবনে তিনি ক্রিকেট ও ফুটবল দু’টিই খেলতেন সমান তালে; ছিলেন ফার্স্ট ডিভিশনের প্লেয়ার। মঞ্চ নাটকেও করতেন অভিনয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রতিটি খেলা দেখতেন খুব আগ্রহ নিয়ে। দলের যে কোন বিজয়ে যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন বার্তা দিতে দেরি করতাম, সঙ্গে সঙ্গে স্যারের ফোন-‘ইমরুল, সবকিছুই কি আমার খেয়াল রাখতে হবে?’ কোন বিষয়ে শোক বার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটতো। 

বিজ্ঞাপন
Advertisement

বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের প্রতি ছিল তার নিখাদ দরদ ও অনুভব। জাতির পিতাকে হত্যার পর শেখ হাসিনা যখন পরিবার নিয়ে ভারতে ৬ বছর বাধ্যতামূলক নির্বাসিত জীবন যাপন করেন, তখন স্যার বঙ্গবন্ধুকন্যাদ্বয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তাদের নয়াদিল্লির বাসায় যেতেন। বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতি তার ছিল নিরন্তর ভালোবাসা। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিটি নির্দেশ পালন করতেন অক্ষরে অক্ষরে। নেত্রীর ব্র্যান্ডিং ও সংবাদ প্রচারের জন্য প্রতিনিয়ত আমাদের দিকনির্দেশনা দিতেন।

কীর্তিমান ইহসানুল করিম ১৮ জুন ২০১৫ হতে ১০ মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত প্রায় ৯ বছর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবেন এই কারণে যে, এ বিশেষ সময়টাতে জননেত্রী শেখ হাসিনা তার দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব গুণে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল; বাংলাদেশ রূপান্তরিত হয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশে; জাতিসংঘ আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আর সারাবিশ্বে আমরা আজ আত্মমর্যাদাশীল জাতির পরিচিতি পেয়েছি।

মহান সৃষ্টিকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা ইহসানুল করিম হেলাল স্যারের ইহকালের সকল নেক কর্মকাণ্ডের পুরস্কার নিশ্চয়ই পরজনমে পরিপূর্ণভাবেই দেবেন-এ প্রার্থনা করি।

লেখক: প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন
Advertisement
Advertisement


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |