গঠন করা হোক বিশেষায়িত উইং

সাঈদুর রহমান রিমন

শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ , ১১:১২ এএম


গঠন করা হোক বিশেষায়িত উইং
লেখক : সাঈদুর রহমান রিমন

অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর মিলন সাহেবের কথা মনে আছে আপনাদের? যিনি অতি সাধারণ সব পদ্ধতির প্রয়োগ  নিশ্চিত করেই যাবতীয় ভেজাল, দুর্নীতি, হয়রানি, দুর্ভোগ নির্মূলে কাজ শুরু করেছিলেন। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’র দায়িত্বশীল পদে যোগ দিয়েই তিনি নামেন ফরমালিন বিরোধী যুদ্ধে। তার রাতদিন অব্যাহত অভিযানের মুখে রাজধানীর কাঁচাবাজার, মাছবাজার, ফল বাজার ঘিরে ছড়িয়ে পড়ে সীমাহীন আতঙ্ক। 

বিজ্ঞাপন

ভেজাল মেশানো দুধের বাজার বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি ভাটা পড়ে মিষ্টির কারখানাগুলোতেও। অন্যদিকে ফরমালিন বিক্রেতারা দোকানপাট, গুদামঘরে তালা ঝুলিয়ে দলে দলে পালিয়ে যান, নিরুদ্দেশ হন। কিন্তু ভেজালমুক্ত খাদ্যপণ্য নিশ্চিতকরণের অঙ্গীকার থেকে একচুলও সরে যাননি মাহবুব কবীর মিলন ও তার টিম সদস্যরা। বরং আদালতে আদালতে ধরনা দিয়ে তল্লাশি ওয়ারেন্ট নিয়ে তারা চড়াও হতে থাকেন বিষাক্ত খাদ্য পণ্যের গুদাম, কারখানা, দোকানপাটে। নকল ভেজাল বিরোধী অভিযানের চেয়েও তার বেশি তৎপরতা লক্ষ্য করা যেতো প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের অনিয়ম-বিশৃংখলার বিরুদ্ধে। দপ্তর, অধিদপ্তরের জনসেবা প্রাপ্তির পয়েন্টসমূহের নানা অরাজকতা মুহূর্তেই বিদায় করে হয়রানিমুক্ত সেবাদানের স্থায়ী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার অনন্য নজির স্থাপন করেন তিনি।  

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ দপ্তরে থাকাকালীন দেশবাসীর জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার যুদ্ধ শুরু করতেই মাহবুব কবীর মিলনকে হঠাৎ সরিয়ে দেওয়া হয় রেলপথ মন্ত্রণালয়ে। দমে যাননি তিনি, সেখানেও দুর্নীত, অব্যবস্থাপনা বিরোধী লাগাতার কর্মযজ্ঞে নেমে পড়েন তিনি। রেলওয়েতে জগদ্দল পাথরের মতো স্থায়িত্ব পাওয়া দুর্নীতি, অনিয়ম, হয়রানি, লুটপাট নিশ্চিহ্ন করে মাত্র কয়েক মাসেই রেল সেক্টরের চেহারা বদলে দিলেন মাহবুব কবীর মিলন ও তার টিম সদস্যরা। সেখানকার দুর্নীতিবাজ, লুটেরাদের বিরুদ্ধে এমনই বিরতিহীন কঠিন যুদ্ধে নামলেন- তাতে অপ্রতিরোধ্য রেল টিকিট চোরদের অপকর্ম পর্যন্ত শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। নাম, ভোটার আইডি নম্বর সম্বলিত অনলাইন টিকেট প্রচলনের মাধ্যমে সর্বসাধারণের জন্য ন্যায্যমূল্যে রেল টিকিট পাওয়াটা তিনি নিশ্চিত করেই ছাড়লেন। 

বিজ্ঞাপন

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ডজন খানেক অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি আর জনভোগান্তি নিশ্চিহ্ন করার পর মাহবুব কবীর মিলন নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন। বললেন, মাত্র দশ জন সৎ কর্মকর্তার একটি উইং পেলে তিনি তিন মাসেই শতভাগ দুর্নীতি মুক্ত মন্ত্রণালয় উপহার দিবেন। দুর্নীতি দূর করার এমন ইচ্ছে প্রকাশ করাই তার জন্য কাল হলো। এ বক্তব্যের জন্য প্রথমে ওএসডি হন তিনি। এরপরই তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। একের পর এক তিরস্কার পত্র দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার মাহবুব কবীর মিলনের মতো সৎ, দেশপ্রেমিক সচিবকে চাকরি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হয়।  

অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর মিলনের মতোই সামাজিক দায়বদ্ধতার শপথ নিয়ে মাঠঘাট কাঁপিয়ে তোলেন রাজউক এর তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ-দৌলা। তার আপোসহীন অভিযানে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দফায় দফায় হয়রানি, অভিযানকালে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ, হামলার মাধ্যমে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা চেষ্টার ছক তৈরি এমনকি উচ্চ আদালতে মামলা দিয়েও থামানো যায়নি রোকন-উদ-দৌলার অভিযান। বরং রাজউকের নিজস্ব সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ-দৌলা‘র কর্মতৎপরতা ছড়িয়ে পড়ে নকল, ভেজাল, জাল-জালিয়াতির নানা সেক্টরে। সর্বত্রই গণমানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেন তিনি।

ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ-দৌলা‘র অব্যাহত অভিযানে বিপর্যস্ত দুর্বৃত্ত চক্রও সংঘবদ্ধ চক্রান্তের মাধ্যমে তাকে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। কর্মহীন দপ্তরে নির্বাসনের মাধ্যমে নির্জীব কর্মকর্তায় পরিণত করায় সফল হয় তারা। এরপর বেশ কিছুদিন দৃষ্টান্তমূলক কর্মকাণ্ড আর দেখতে পাননি দেশের মানুষ। 

বিজ্ঞাপন

তবে অপ্রাপ্তির শূন্যতা কাটিয়ে আবার হৈচৈ সৃষ্টিতে সক্ষম হন র‌্যাবে কর্মরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম। র‌্যাব এর রুটিন ওয়ার্কের বাইরেও অপরাধমূলক নানা ক্ষেত্রে অভিযানিক তৎপরতা চালিয়ে দুর্বৃত্তদের তটস্থ করতে থাকেন তিনি। জনসাধারণের শ্রদ্ধা-ভালাবাসায় দিন দিনই দায়িত্বশীলতা বাড়িয়ে ভেজাল, অপরাধ ও দুর্নীতিবিরোধী সার্বক্ষণিক ভ্যানগার্ডে রুপান্তর হন ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম। সংঘবদ্ধ চক্রের দাপুটে থাবার শিকার হতে তারও খুব বেশি সময় লাগেনি। অব্যর্থ চক্রান্তে দায়িত্বশীল কর্মকাণ্ড থেকে সরে যেতে হয়, পরে পদোন্নতি দিয়ে আরো নির্জীবতায় স্থানান্তর করা হয় এই ম্যাজিস্ট্রেটকে। 

বিগত দুই দশকে দেশ ও জনস্বার্থে এমন ব্যতিক্রমী নানা ভূমিকায় বেশ কিছু দেশপ্রেমী কর্মকর্তাকে দেখতে পেয়েছেন মানুষজন। তাদের হাতেই সমাজ রাষ্ট্রের নানা অসংগতি নিশ্চিহ্ন হবে- এমন স্বপ্নের আলোচ্ছ্বটায় অপেক্ষমাণ থাকতেন দেশবাসী। কিন্তু খুবই সীমিত সময়ের মধ্যেই তাদের সে আশা বালির বাঁধের মতোই মিইয়ে যেতো, কখনই তা স্থায়িত্ব হতো না।

মাহবুব কবীর মিলন, ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ-দৌলা, ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম, পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং এন্ড এনফোর্সমেন্ট উইংয়ের সাবেক পরিচালক মো. মনিরুল আলমের আপোসহীন ভূমিকার কথা গোটা দেশবাসী জানেন। তাদেরকে আজও নিরাপদ ভরসাস্থল ও আস্থার প্রতীক হিসেবেই মনে করেন মানুষজন। অথচ সৎ, দক্ষ, প্রতিশ্রুতিশীল কর্মকর্তাদের মূল দায়িত্ব থেকে সরিয়ে বরাবরই ‘মাছিমারা কেরানি’ বানিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। অনেক ক্ষেত্রে সীমাহীন আক্রোশে তাদের বিতাড়িত করা হয় অথবা চাকরি থেকে বরখাস্ত করে বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়। অনেক অনেক খারাপ দৃষ্টান্তের মধ্যেও মানবিক গুণসম্পন্ন সৎ, দক্ষ, সামাজিক দায়বদ্ধতার অঙ্গীকারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমান মিজান, শেখ আমিনুল বাসার, মো. জাহিদুল ইসলামদের মতো অনেকের অবস্থানও রয়েছে দেশে।

এমন যোগ্য, দক্ষ, নির্লোভ কর্মকর্তাদের ডেপুটেশনে কিংবা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হোক। মাহবুব কবীর মিলনের তত্ত্বাবধানে বানিয়ে দেয়া হোক কাঙ্ক্ষিত উইং। সর্বত্র সব রকম অভিযানিক ক্ষমতাও দেওয়া হোক তাদের। উপদেষ্টারা সংস্কারের মতো দীর্ঘমেয়াদি কাজে ব্যস্ত থাকুন- দশ কর্মকর্তার উইং বাজার সিন্ডিকেট গুড়িয়ে দেওয়াসহ দূর করতে থাকুক যাবতীয় অরাজকতা।

 লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন

Loading...


© All Rights Reserved 2016-2025 | RTV Online | It is illegal to use contents, pictures, and videos of this website without authority's permission