• ঢাকা বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩১
logo

হেমন্ত ঋতু: প্রকৃতির শীতল আলিঙ্গন

  ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:০৪
হেমন্তের হালকা কুয়াশা ও শিশিরমাখা স্নিগ্ধ সকাল । ছবি : ইন্টারনেট

আজ পহেলা কার্তিক, হেমন্তের শুরু। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ—এই দুই মাস নিয়ে চিরায়ত হেমন্তকাল। কৃত্তিকাআর্দ্রা এ দুটি তারার নাম অনুসারে নাম রাখা হয়েছে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসের। কার্তিকের পর আসে সর্বজনীন লৌকিক উৎসব নবান্ন। ‘অগ্র’ ও ‘হায়ণ’ এ দুটি অংশের অর্থ যথাক্রমে ‘ধান’ ও ‘কাটার মৌসুম’। সম্রাট আকবর অগ্রহায়ণ মাসকেই বছরের প্রথম মাস বা খাজনা তোলার মাস ঘোষণা করেছিলেন। এ সময় ধান কাটা হয়।

শীতের বার্তা নিয়ে হাজির ভোরের শিশির

শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে ধীর পায়ে প্রকৃতিতে আসে হেমন্ত। বাংলাদেশের ছয়টি ঋতুর মধ্যে হেমন্ত একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। শরৎ ঋতুর কাশফুলের শুভ্রতা আর বর্ষার পরিপূর্ণতা পেরিয়ে যখন প্রকৃতি শীতের আলিঙ্গনে ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকে, তখনই আসে হেমন্ত। হেমন্ত ঋতু বাংলার গ্রাম্যজীবন এবং কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। প্রকৃতি, ফসল, সংস্কৃতি—সবকিছুতেই হেমন্ত তার নিজস্ব প্রভাব ছড়িয়ে দেয়।

হেমন্তে দিনের বেলা রোদের মিষ্টি আভা আর রাতের শীতল হাওয়া প্রকৃতির এক বিশেষ সৌন্দর্য এনে দেয়। চারপাশে সাদা মেঘের ভেলা, খোলা আকাশ আর শিশির ভেজা ঘাসের ওপর ভোরের আলো—সব মিলিয়ে হেমন্তের একটি নির্মল, স্বচ্ছ রূপ ধরা পড়ে। এই ঋতুতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার রূপ দেখা যায়। শীতের পূর্বাভাস নিয়ে আসা এই ঋতুর হাওয়ায় এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব হয়।

ভোর হতেই ধানের মাঠে কাজে নেমেছেন কৃষক


বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে হেমন্তের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই সময়ে কৃষকেরা আমন ধান কাটার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ধানের শীষগুলো সোনালি রং ধারণ করে, যা মাঠে এক অপূর্ব দৃশ্য তৈরি করে। হেমন্তের ফসল কাটা মানে বছরের কঠোর পরিশ্রমের ফলাফল। এই সময়েই নবান্ন উৎসব পালিত হয়, যেখানে নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন খাবার। নবান্ন বাঙালি জীবনের এক ঐতিহ্যবাহী উৎসব, যা হেমন্ত ঋতুর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।


হেমন্ত ঋতুতে আবহাওয়া ধীরে ধীরে শীতল হতে শুরু করে। সকালে ঘাসে শিশিরের বিন্দু দেখা যায়, যা শীতের আগমনের সূচনা করে। গাছের পাতা ঝরে যেতে শুরু করে এবং প্রকৃতির মাঝে একধরনের নীরবতা নেমে আসে। পাখিদের কাকলিও কিছুটা কমে আসে। নদীর জল আরও শান্ত হয়ে ওঠে, আর গ্রাম্যজীবনে শুরু হয় শীতের প্রস্তুতি।


বাংলা সাহিত্যে হেমন্ত ঋতু অত্যন্ত প্রিয় একটি বিষয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেক বিখ্যাত কবি তাদের লেখায় হেমন্তের রূপ, ফসলের সোনালি আভা এবং শীতলতার কথা তুলে ধরেছেন। হেমন্তের সৌন্দর্য, ধানের শীষের দোলা, এবং শীতের আগমনের অনুভূতি সাহিত্যিকদের মনের গভীরে দাগ কেটেছে। বাঙালি সংস্কৃতিতে হেমন্ত ঋতু তাই শুধু প্রকৃতির পরিবর্তন নয়, এটি আবেগ, আনন্দ এবং শৈল্পিকতারও এক প্রতীক। বাংলার বর্ষা ঋতু যদি হয় রবীন্দ্রনাথের, হেমন্ত তবে জীবনানন্দ দাশের। তাই তো তার কাছেই ফেরা যাক, ‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে/ অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে;/ মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার—চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ,/তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান।’


বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হেমন্তে বিভিন্ন ধরনের উৎসব পালিত হয়। নবান্ন তো আছেই, এর সঙ্গে নতুন ধান ঘরে তোলার পর ধান মাড়াই এবং মিষ্টান্ন তৈরি করে পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে বিতরণ করা হয়। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলি খাওয়ার সময়ও এটি। গ্রামীণ এলাকায় হেমন্তের এই উৎসবগুলো মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন ও সাম্প্রদায়িক মিলনের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।

মাঠের কাঁচা ধান পাকলে তা কাটা ও নবান্ন উৎসবও হবে এই ঋতুতে

হেমন্ত ঋতু প্রকৃতির সঙ্গে বাঙালির এক অটুট সম্পর্কের প্রতীক। শীতের আগমনের আগে হেমন্ত একদিকে নিয়ে আসে ফসলের স্বর্ণালী সমৃদ্ধি, অন্যদিকে প্রকৃতির রূপান্তরের এক মৃদু আভাস দেয়। শান্ত, সুন্দর এবং প্রেরণাদায়ক এই ঋতু বাংলার প্রকৃতি ও সংস্কৃতিতে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রয়ে গেছে।

মন্তব্য করুন

Radhuni
  • অন্যান্য এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
পঞ্চগড়ে ঘন কুয়াশায় শরতেই শীতের আগমনী বার্তা
‘মেরুদণ্ড শীতল করা তথ্য ফাঁস হচ্ছে, কী বিভৎস ক্ষমতার এই লোভ’
বৃষ্টির সময়ও ফ্যাশনেবল থাকবেন যে ৫ টিপসে
শীতলক্ষ্যার ভাঙনে হুমকিতে অর্ধশত পরিবার