রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ যদি না করেন, অপসারণ কতটা সম্ভব
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির প্রেক্ষাপটে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই রাষ্ট্র সংস্কারের বিভিন্ন ইস্যুতে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যস্ত শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এসবের মাঝেই সরকারের জন্য হঠাৎ বড় এক সংকট হয়ে উঠলো রাষ্ট্রপতির অস্তিত্বের প্রশ্ন। এমনিতেই বিগত আওয়ামী লীগ সরকার মনোনীত রাষ্ট্রপতি হওয়ায় মো. সাহাবুদ্দিনের স্বীয় পদে বহাল থাকা নিয়ে এক ধরনের চাপা অস্বস্তি বিরাজ করছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থকগোষ্ঠীর মধ্যে। এবার তা রীতিমতো বিক্ষোভে পরিণত শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র জমা নিয়ে দেওয়া এক মন্তব্যের জেরে।
সম্প্রতি মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘আমি শুনেছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু আমার কাছে এ সংক্রান্ত কোনো দালিলিক প্রমাণ বা নথিপত্র নেই।’
রাষ্ট্রপতির এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হওয়ার পর পরই তীব্র সমালোচনার ঝড় ওঠে সব মহলে। একদিকে বর্তমান সরকার নিয়ে যেমন প্রশ্ন ওঠে সমালোচকগোষ্ঠীর মধ্যে, অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও এর সমর্থকগোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র হয়ে ওঠে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি। সরাসরি ক্ষোভ প্রকাশ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টাও।
এ অবস্থায় গতকাল মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবি নিয়ে বঙ্গভবন ঘেরাও করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও সমর্থকরা। অতি উৎসাহী কেউ কেউ আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তা বলয় ভেঙে বঙ্গভবনে ঢুকে পড়ার চেষ্টাও চালান। বঙ্গভবনের বিলাসিতা ছেড়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে নিজের রাস্তা দেখার কথা বলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সমাবেশ ও বিক্ষোভ থেকে দাবি ওঠে, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ করতে হবে এ সপ্তাহের মধ্যেই।
এছাড়া ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর, ময়মনসিংহ, পাবনা, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার, ফেনী, মেহেরপুর, নড়াইল ও ঝিনাইদহ থেকেও বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে। জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও একই দাবিতে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা।
এদিকে সরকারের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, গত দুই দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের বক্তব্য এবং শিক্ষার্থীদের ব্যাপক বিক্ষোভে প্রস্তুত হয়ে গেছে রাষ্ট্রপতির বিদায়ের মঞ্চ। রাষ্ট্রপতি নিজে থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলে ভালো। না হলে সরকারের পক্ষ থেকে একটা অবস্থান পরিষ্কার করা হতে পারে। উপদেষ্টা পরিষদের বৃহস্পতিবারের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। তখন সব দিক বিবেচনা করে সরকারের করণীয় ঠিক করা হবে।
সরকারের একাধিক উপদেষ্টা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেওয়া হবে কি না—বিষয়টি নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে বহুবার আলোচনা হয়েছে। তবে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেওয়া হবে কি হবে না—এমন সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি এখন পর্যন্ত।
কোনো কোনো উপদেষ্টা এসব আলোচনায় মত দিয়েছেন যে রাষ্ট্রপতিকে রেখে দিলে যেকোনো সময় অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দিতে পারেন। আবার কারও কারও মত ছিল, সংসদ না থাকায় রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের একমাত্র পথ হচ্ছে পদত্যাগ। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদ, যাতে বলা আছে, রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে ক্ষেত্রমতো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন।
কিন্তু জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী গত ২ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেছেন। ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। এর আগে গত ৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
ফলে রাষ্ট্রপতিকে সরানোর চেয়ে সংস্কার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকেই সরকারের অগ্রাধিকার হিসেবে বেছে নেওয়া হয় উপদেষ্টা পরিষদের আলোচনায়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। সরকারকে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে একমত উপদেষ্টা পরিষদ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যদি রাষ্ট্রপতি নিজে থেকে পদত্যাগ না করেন সংসদের অনুপস্থিতিতে তাকে অপসারণ সম্ভব কি না। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, রাষ্ট্রপতিকে সরানো যায় দুইভাবে। একটি হলো অভিসংশন করলে বা বাদ দিলে, আরেকটি হলো স্পিকারের মাধ্যমে সংসদে। কিন্তু বর্তমানে সংসদ ও স্পিকার দুটোই নেই। তাই সাংবিধানিক শূন্যতা হবে। এখন হয়তো কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু ভবিষ্যতে তো আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে কথা উঠতে পারে। নিয়ম মেনে করলে সব কিছুই করা যেত। কিন্তু পরিস্থিতি একটু স্থিতিশীল হলেই অনেকে প্রশ্ন তুলবে।’
আবার সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট আহসানুল করীম বলেন, রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করে স্পিকারের কাছে জমা দিবেন। যদিও স্পিকার পদত্যাগ করেছেন। এখানে দুটো আর্টিক্যাল জরুরি, আর্টিক্যাল সেভেনটি ফোর সাব আর্টিক্যাল সিক্স, তার সঙ্গে পড়তে হবে আর্টিক্যাল ফিফটি ফোর। সংবিধানের ৭৪ অনুচ্ছেদের ৬ ধারায় বলা আছে, এই অনুচ্ছেদের (২) দফার বিধানাবলী সত্ত্বেও ক্ষেত্রমতো স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল রয়েছেন বলে গণ্য হবে।
এভাবে রাষ্ট্রপতি অপসারণ হলে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আবার আরেকটি প্রশ্ন তৈরি হয়, শূন্যস্থানে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ হবেন কীভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে আহসানুল করীম বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি নিয়োগ হয় না। রাষ্ট্রপতি নিয়োগ শুধু সংসদ করতে পারে।’
রাষ্ট্রপতির অপসারণ প্রক্রিয়া কী হবে এবং পদত্যাগ করলে কার কাছে জমা দিবেন এ নিয়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনিক আর হকও বলছেন, বিষয়টি নিয়ে খুবই জটিলতা তৈরি হয়েছে। তবে সময়ের আলোকে সম্পূর্ণ পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর সবকিছু নির্ভর করবে।
অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও আইনের শিক্ষকদের একটি অংশ বলছেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর ‘আইন ও সংবিধানের’ বিষয়টিই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। ফলে ‘জনআকাঙ্ক্ষার’ আলোকে রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে অন্য কাউকে সে পদে বসাতে চাইলে সেটি অসম্ভব কিছু নয়। যদিও সরকার পরিবর্তনের পর দেশের সংবিধান স্থগিত করা হয়নি।
অনেকে আবার বলছেন, রাষ্ট্রপতি নিজে থেকে পদত্যাগ করবেন কি না, এটা একটা বড় প্রশ্ন। সরকার থেকে পদত্যাগে চাপ দেওয়া যেতে পারে। তবে, তা অতীতে বিভিন্ন বাহিনীর মাধ্যমে হয়েছে। এখন অবশ্য ছাত্ররা রাজপথে নামার ফলেও চাপ তৈরি হয়েছে।
এদিকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো বার্তা পাওয়া যায়নি সরকারের পক্ষ থেকে। বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ করেননি রাষ্ট্রপতিও।
অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি বিদায়ের যত ঘটনা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনার পর নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের সমর্থন নিয়ে ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট খন্দকার মোশতাক সামরিক আইন জারি করে নিজেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নেন। এরপর তিনি নিজেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন।
এরপর ৩ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের মুখে খন্দকার মোশতাক আহমদ ৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরদিন সামরিক কর্মকর্তাদের অনুরোধে নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম।
১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন বিচারপতি সায়েম। রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন জিয়াউর রহমান।
অন্যদিকে প্রবল গণ আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সাবেক সামরিক শাসক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ওইদিন প্রথমে পদত্যাগ করেছিলেন তখনকার ভাইস প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমেদ। এরপর জেনারেল এরশাদ বিচারপতি সাহাবুদ্দিনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেন এবং নিজে পদত্যাগ করেন। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন।
আরটিভি/এসএইচএম/এআর
মন্তব্য করুন