• ঢাকা রোববার, ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২১ পৌষ ১৪৩১
logo

ফিরে দেখা ২০২৪

রায়ে-রায়ে ইতিহাস, পাল্টে দেয় দেশ

  ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬:৪৮
আদালত
ছবি: সংগৃহীত

দেশে ইতিহাস সৃষ্টির যে উপাদান তা গড়ে ওঠেছে আদালত থেকে। এমনটাই দেখা গেছে গেল বছর। এই সময়ে একের পর এক রায় দেশের মানুষকে নাড়া দিয়েছে। বিতর্কিত রায়গুলোতে যেমন মানুষ হয়েছে উত্তেজিত, আবার একই আদালতের রায়ে হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন তারা। তবে শাসক প্রশ্নে অনেক কিছুই হয়েছে যা, এই আদালতকে কোণঠাসা হতে হয়েছে।

গেল বছরের মাঝামাঝিতে সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসে দেশের উচ্চ আদালত থেকে। একটি ‘বিতর্কিত’ রায়কে কেন্দ্র করে শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। বলতে গেলে ইতিহাস পাল্টে দেওয়া ছিল এই রায়।

শুধু কি এই রায়। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল পুনর্বহালের রায়, বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানসহ সব আসামিকে খালাসের রায়, জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত ও খালাসের আদেশ, বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় অবৈধ ঘোষণা, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় বাবরসহ সাত আসামিকে খালাসের রায়।

তবে তার চেয়েও বড় আলোচিত ঘটনা ছিল ছাত্র-জনতার দাবির মুখে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতি পদত্যাগ। একই সঙ্গে এই বছরেই প্রথম কোনো বিচারপতি হাইকোর্ট বিভাগ থেকে সরাসরি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।

শেখ হাসিনা সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করার অভিযোগে এ বছরই উচ্চ আদালতের ১২ বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠানো হয়।

বিপরীত দিকে তাকালে দেখা যায় ব্যাটারিচালিত রিকশা শ্রমিকদের চাপের মুখে আদালতের রায় রদ করতে। আদালতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের আদেশ দেন। সেই আদেশকে কেন্দ্র করে ঢাকায় রিকশাচালকরা আন্দোলন করেন। পরে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে চেম্বার আদালত হাইকোর্টের রায়ে ‘স্থিতাবস্থা’ জারি করেন।

শুরুর গল্প, কোটাবিরোধী আন্দোলন। বিদায়ী বছরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ কোটা পদ্ধতি বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে বলা হয়, ২০১২ সালে করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেওয়া রায় ও আদেশ, ২০১৩ সালের লিভ টু আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগে তা বহাল ও সংশোধিত আদেশ এবং ২০১১ সালের ১৬ জানুয়ারির অফিস আদেশের (মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনির কোটা) আলোকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান/নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা পুনর্বহাল করতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হলো। একই সঙ্গে জেলা, নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, উপজাতি-ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য কোটাসহ, যদি অন্যান্য থাকে, কোটা বজায় রাখতে নির্দেশ দেওয়া হলো। আদেশ পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে পরিপত্র জারি করতে নির্দেশও দেওয়া হয় একই সঙ্গে।

এই রায়কে কেন্দ্র করে কোটা বিরোধী আন্দোলন ফের প্রকম্পিত হয় রাজপথ। ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।

প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পদত্যাগ দাবিতে সেদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বর্ধিত ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। ছাত্র-জনতার দাবির মুখে পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি। পাঁচ বিচারপতি হলেন, এম ইনায়েতুর রহিম, মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, জাহাঙ্গীর হোসেন, মো. শাহিনুর ইসলাম ও কাশেফা হোসেন।

উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতিকে লক্ষ্য করে এজলাস কক্ষে ডিম ছুড়ে মারার ঘটনাও ছিল বেশ আলোচিত। ঘটনাটি ঘটে ২৭ নভেম্বর। ২০১৬ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে নিয়ে মন্তব্যের জেরে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে হট্টগোল ও একপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিকে লক্ষ্য করে ডিম ছুড়ে মারে সংক্ষুব্ধরা। এরপর বিচারপতি এজলাস থেকে নেমে যান।

এদিকে, ১০ আগস্ট নতুন সরকারের সময় হাইকোর্ট বিভাগ থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। ঘটনা শুরু হয় ওবায়দুল হাসানের পদত্যাগের পর। কে হবেন প্রধান বিচারপতি, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। সেই সময় আপিল বিভাগে মাত্র একজন বিচারপতি অবশিষ্ট ছিলেন। তিনি হলেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম। তাকেই ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সিদ্ধান্ত হয়।

ফের উত্তপ্ত হয় রাজপথ। দাবি ওঠে, ছাত্র-জনতা প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদকে চান। অন্য কোনো বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে তা মেনে নেওয়া হবে না—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা এমন ঘোষণা দেন।

অবশেষে ১০ আগস্ট রাতেই বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদকে দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনিই প্রথম বিচারপতি যিনি হাইকোর্ট বিভাগ থেকে সরাসরি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। দেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।

১২ বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠানোর ঘটনা ঘটে একই বছর। যা খুব আলোচিত। গত ১৬ অক্টোবর এ ঘটনা ঘটে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দুর্নীতি ও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের দোসর হিসেবে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ এ সিদ্ধান্ত নেন। এরপর থেকে তাদের আর হাইকোর্টের বেঞ্চে বিচারকাজ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।

এদের মধ্যে রয়েছেন- বিচারপতি নাইমা হায়দার, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস, বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার, বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামান, বিচারপতি আতাউর রহমান খান, বিচারপতি শাহেদ নূর উদ্দিন, বিচারপতি মো. আক্তারুজ্জামান, বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলাম, বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলন, বিচারপতি খিজির হায়াত ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামান।

বর্তমান সরকারের সুবিধা এনে দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় অবৈধ ঘোষণা। যেই ঘোষণা দেন হাইকোর্ট। রায়ে হাইকোর্ট বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটা বাতিল করা হচ্ছে না। বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে আগামী জাতীয় সংসদ আইন অনুসারে জনগণের মতামত নিয়ে সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে। এর মধ্যে জাতির পিতার স্বীকৃতির বিষয়, ২৬ মার্চের ভাষণের বিষয়গুলো থাকবে।

একে একে মামলা থেকে খালাস পান খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, বাবরসহ অনেকেই। যা কল্পনা করতে পারেনি তারা নিজেরাও। গত ১১ নভেম্বর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের সাজার বিরুদ্ধে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে করা আবেদন) মঞ্জুর করেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে খালেদা জিয়াকে দেওয়া ১০ বছরের সাজাও স্থগিত করেন আদালত। আপিল শুনানি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকবে সাজা।

অপরদিকে গত ২৭ নভেম্বর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে সাত বছরের দণ্ড থেকে খালাস দেন হাইকোর্ট। সাজার বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার আপিল মঞ্জুর করে ওই দিন বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সব আসামিকে খালাস দেন হাইকোর্ট। গত ১ ডিসেম্বর বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।

বিদায়ী বছরে বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সাত আসামিকে খালাস দেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়ার সাজা কমিয়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন করা হয়।

ঢাকায় রিকশা চলাচল বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশ পরে চেম্বারে স্থিতাবস্থা দেয় চালকদের আন্দোলনের ফলে। গত ১৯ নভেম্বর ঢাকা মহানগর এলাকায় তিন দিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এটি বন্ধে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি মাহমুদুর রাজীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

স্বরাষ্ট্র সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব, আইজিপি, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের আদালতের এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার এইচ এম সানজিদ সিদ্দিকী ও ব্যারিস্টার তাহসিনা তাসনিম মৃদু।

এ রায়কে কেন্দ্র করে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল করে। চেম্বার আদালত হাইকোর্টের রায়ে স্থিতাবস্থা জারি করেন। পরে আন্দোলন থেকে সরে আসেন রিকশাচালকরা।

একের পর এক ঘটনাই বলে দেয় গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ আদালত তথা বিচার বিভাগ। যা শুধু গণতন্ত্র নয় একটি দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রধান ভূমিকা রাখে।

আরটিভি/এএইচ/এআর

মন্তব্য করুন

Bangal
rtv Drama
Radhuni
  • বাংলাদেশ এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ি দেখে দৌড়, এরপর যা ঘটল 
দর্শনায় অবৈধভাবে সার মজুত, লাখ টাকা জরিমানা
চট্টগ্রামে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা মামলার আসামি ঢাকায় গ্রেপ্তার
চিন্ময় দাসের জামিন নামঞ্জুর