ফারুকের শূন্যতা কি কখনো পূরণ হবে? এই প্রশ্ন এখন সিনেমাপ্রেমীদের মনে। আরেকজন ফারুকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে কত দিন? এমন প্রশ্নও উঠছে। একে একে চলে যাচ্ছেন কিংবদন্তিতুল্য অভিনেতারা। কিন্তু তাদের উত্তরসূরি বেরিয়ে আসছে না।
রাজ্জাক, ফারুক, উজ্জ্বল, আলমগীর, সোহেল রানা, ওয়াসিম। শুধুমাত্র সত্তর দশকেই ঢাকাই সিনেমায় রাজত্ব করেছেন এতগুলো সুপারস্টার। সেই একই ইন্ডাস্ট্রিতে এক দশক ধরে আজ শুধু একজন সুপারষ্টার- শাকিব খান।
কেন নায়কের জন্য এমন গগণবিদারী হাহাকার? কেন এই ভয়াবহ নায়ক সংকট?
জনপ্রিয় নায়কহীন ইন্ডাস্ট্রির জন্য নায়কদের ব্যর্থতা সামান্যই। ব্যর্থতার জন্য দায়ী নির্মাতারা। নায়ক মাটি ফুঁড়ে বেরোয় না। তারুণ্যের ভেতরে নায়কের বীজ বুনতে হয়, তার যত্ন নিতে হয়, তাকে গড়ে তুলতে হয়। তখনই একজন সাধারণ যুবক হয়ে ওঠে সুপারস্টার, একটা সময় গিয়ে মাথা তুলে হয় কিংবদন্তি।
ফারুকের কথা দিয়েই শুরু করা যাক। খান আতা পরম মমতায় এক পাগলাটে তরুণের ভেতরে শিল্পীর হৃদয় প্রতিস্থাপন করেছিলেন। ‘আবার তোরা মানুষ হ’ থেকে ‘সুজনসখী’; এই সময়ের মধ্যে একজন দক্ষ ভাস্করের মতোই ছেনে-ছেনে ফারুককে গড়েছিলেন খান আতা। মিতাও তখন এগিয়ে এসেছিলেন। মিতা-ফারুক ও আতা-ফারুক জুটি এই বিখ্যাত দুই নির্মাতার মৃত্যু অবদি টিকেছিল।
রাজ্জাককে নবজন্ম দিয়েছিলেন জহির রায়হান। ‘বেহুলা’, ‘আনোয়ারা’, ‘সংসার’, ‘জীবন থেকে নেয়া’- কত কত ক্ল্যাসিক দুজনের। কলকাতাফেরত এক সংগ্রামী যুবককে জহির রায়হান এদেশের কোণায় কোণায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। সাধারণ চোহারা ও গড়নের এক বিবাহিত যুবককে আশ্চর্য ছাঁচে ফেলে জহির রায়হান সৃষ্টি করেছিলেন রাজ্জাকের অভিনব ভাবমূর্তি। কাজী জহির, মিতারাও তাদের হাত লাগিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে পশ্চিমাদের জবাব দেয়ার জন্য এক মজবুত হাতিয়ার গড়তে।
উজ্জ্বলের কথা বলা যাক এবার। ‘বিনিময়’ ছবিতে সুভাষ দত্ত একজন দক্ষ প্রকৌশলীর মতোই মেপে মেপে গড়ে দিয়েছিলেন উজ্জ্বলের ভিত্তি। যে উজ্জ্বল দশকের পর দশক ধরে ওস্তাদের বিদ্যার জোরে দর্শক-হৃদয় শাসন করেছেন। রোমান্টিক নায়ক থেকে ‘নসীব’ ছবিতে উজ্জ্বলকে অ্যাকশন নায়কে পরিণত করেছিলেন মমতাজ আলী। আজো তার প্রতি উজ্জলের মাথা নত হয়ে আসে যখন ভাবেন একজন নির্মাতা কতোটা দক্ষতায় একজন শিল্পীর খোলনলচে বদলে দিতে পারেন।
সুভাষ দত্ত ‘বিনিময়’ ছবিতে যেভাবে আবিষ্কার করেছিলেন উজ্জ্বলকে, সেভাবেই তিনি ‘সকাল সন্ধ্যা’ ছবিতে জসীমকে নায়করূপে দর্শকদের সামনে এনেছিলেন আর ইলিয়াস কাঞ্চনের অভিষেক ঘটিয়েছিলেন ‘বসুন্ধরা’ ছবিতে। উজ্জ্বল, জসীম, ইলিয়াস কাঞ্চন; তাদের প্রত্যেককেই ‘মানুষ’ থেকে ‘শিল্পী’ বানিয়েছিলেন সুভাষ দত্ত।
সুভাষ দত্তের মতোই শিল্পী আবিষ্কারের নেশায় আক্রান্ত ছিলেন এহতেশাম। তার হাত ধরে এদেশের প্রথম সুপারষ্টার রহমানের জন্ম-বিকাশ-প্রতিষ্ঠা। ‘রাজধানীর বুকে’ ছবিতে রহমানকে আবিষ্কার, তারপর তাকে নিয়েই এহতেশামের যুগান্তকারী নির্মাণ ‘নতুন সুর’ আর ‘চান্দা’। রহমানকে নিয়েই এহতেশামের ভাই মুস্তাফিজ নির্মাণ করেন ‘হারানো দিন আর ‘তালাশ’। এই যে দুই ভাইয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় সুপারস্টার বনে গেলেন এক সাধারণ যুবক, এ তো আজ কেবলই ইতিহাস। যার নমুনা এখন আর কোথাও মেলে না। এহতেশাম ছিলেন বলেই নাদিমের মতো নায়ক তরুণীদের হৃদয় ভাসিয়ে ছবিঘরে বয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। আবার সত্তরের জহুরী এহতেশামই নব্বই দশকে নাঈম, সাব্বির, শামসকে উপহার দিয়েছিলেন। যার মধ্যে নাঈম খুব অল্প সময়ে ইন্ডাস্ট্রিতে থেকেও ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন।
এহতেশাম-মুস্তাফিজ ভ্রাতৃদ্বয়ের মতোই সৃজনশীল দুনিয়ার দুই ভাই মাসুদ পারভেজ ও শহীদুল ইসলাম খোকন ইন্ডাষ্ট্রিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রুবেলকে। ‘লড়াকু’র সুপারহিট সাফল্যের পরও যে পাশে থেকে একটা পর একটা ছবিতে নতুন নতুন চরিত্র সৃষ্টি করে নায়ককে দর্শক-হৃদয়ে জায়গা করে নেয়ার ধারাবাহিক সুযোগ দেয়া; এভাবেই তো একজন নায়ক সুপারষ্টার থেকে কিংবদন্তিতে পরিণত হন।
কাজী হায়াত পুত্র স্নেহে বড় করে তুলেছেন মান্নাকে। ‘পাগলী’ থেকে ‘মিনিষ্টার’; দুই দশকে কখনোই মান্নার হাত ছাড়েননি কাজী হায়াত। ঔরসজাত পুত্র কাজী মারুফকেও ‘ইতিহাস’ ছবিতে নবজন্ম দেন কাজী হায়াত, ছেলেকে উপহার দেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও।
রাজ্জাককে সৃষ্টি করে যে ঋণ তার ওপরে চাপিয়ে গিয়েছিলেন জহির রায়হান, সেই ঋণ পুত্র বাপ্পারাজকে সিনেমায় দান করে নায়করাজ শোধ করেন। সোহেল রানার মতো আজিজুর রহমান বুলিও ছোট ভাই মাহমুদ কলিকে নিরন্তর সমর্থন দিয়ে সিনেমায় প্রতিষ্ঠিত করেন। বংশপরম্পরায়ও যদি ইন্ডাস্ট্রিতে শিল্পীর প্রবাহ অব্যাহত থাকতো, তবেও কি সিনেমার চাকা সচল থাকতো না?
দেশের খ্যতিমান পরিচালক ইবনে মিজান, দারাশিকো, আজমল হুদা মিঠুরা তাদের পুত্রদেরকে সিনেমায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টার ত্রুটি করেননি। যদিও তারা শেষ বিচারে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু শিল্পী তৈরির তাগিদ এই নির্মাতারা অনুভব করেছিলেন। অন্যদিকে সিনেমার রক্ত ধারণ না করেও সোহানুর রহমান সোহান একাই সালমান শাহ, শাকিল খান ও শাকিব খান নব্বই দশকের এই তিন সুপারষ্টারের আবিষ্কারক। নব্বই দশকের সেই টগবগে সোহান ফিরে না এলে নতুন কোনো সালমান শাহ’র ভূমিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা কতখানি?
মোহাম্মদ হোসেনের মতো একজন প্রযোজক-পরিচালক যার কোনো ইতিবাচক অবদানই নেই ঢাকাই সিনেমায়, সেই তিনিও একজন তরুণকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন নায়ক হিসেবে। প্রথম ছবি থেকে শুরু করে আমিন খানকে বছরের পর বছর নিজের ব্যানারে সুযোগ দিয়ে গেছেন মোহাম্মদ হোসেন।
শিল্পী তৈরির সংস্কৃতি এদেশের সিনেমা শিল্পের সমান পুরনো। আজ সেই মাপের মেধাবী, সুযোগ্য ও কুশলী নির্মাতা নেই যারা শিল্পী তৈরি করতে পারেন। আজকের নির্মাতারা নতুন নতুন নায়ক পয়দা করতে পারেন। কিন্তু তাদের প্রতিপালনের ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা নেই পৃষ্ঠপোষকতার। শাসনের অভাবে, শিষ্টাচারের অভাবে নায়করা বখে যান, বিপথে চলে যান। তাই আমরা উপযুক্ত নায়কের শূন্যতায় ভুগি। হাল ধরার মতো শক্ত নায়কের সংকটে এদেশের সিনেমা শিল্প আজ ধ্বংসপ্রায়।
লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, আরটিভি