স্কুলের পেছনের বাউন্ডারি ঘেঁষা রাস্তাটি আজাদ মসজিদের দিকে গেছে। বিপরীত দিকে দুইশ কদম পা বাড়ালেই লাল ইট কালো গেইট, ঘন সবুজের মায়াঘেরা বাড়িটির নাম লক্ষ্মীকুঞ্জ। নাহ, বাড়ির আলাদা বিশেষত্ব নেই। আর তখন তো গুলশানের সব বাড়ির চেহারাই ছিল প্রায় একরকম। ১৫-২০ কাঠার একেকটা প্লট, দেয়াল ঘেরা মাঠের মতো খোলা জায়গায় ছোট্ট একতলা ভবন। লক্ষ্মীকুঞ্জও সে রকম একটি বাড়ি। তবু দূর-দূরান্ত থেকে বহুলোক সেটি দেখতে ভিড় জমাত। কেন এই ভিড়? জি, ওই বাড়িটি নায়করাজের।
সময়টা ছিল আশির দশকের মাঝামাঝি। পড়ি ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভে। গুলশান মডেল হাই স্কুলটা তখন ছিল সেই বিখ্যাত লক্ষ্মীকুঞ্জের কাছাকাছি। প্রধান সড়কে কিছু যানবাহন আর কোলাহলের শব্দ ছাড়া সত্যিই নীরব এলাকা ছিল গুলশান। স্কুল পালিয়ে কিংবা টিফিন পিরিয়ডে ডানপিটে আমরা আশপাশের নিস্তব্ধ বাড়িগুলোতে সুযোগ পেলেই হানা দিতাম। ডাসা পেয়ারা, টকটকে ডালিম, কচকচে আম আর ডাব বা নারকেলই আমাদের টার্গেট।
লক্ষ্মীকুঞ্জের সামনে গিয়ে বারবার আমরা হতাশ হতাম। সাড়ে চার ফুট বাউন্ডারি ঘেরা বাড়ির আঙিনায় ফলের গাছের ছড়াছড়ি। লাল সিরামিক ইটের বাউন্ডারিতে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালেই টুপ করে ছিড়ে আনতে পারি ঝুলন্ত কদবেল, এক ঝাঁকিতেই পেতে পারি পকেটভর্তি বড়ই। কিন্তু ক্যামনে কী? সবসময়ই তো জটলা পাকানো কিছু লোককে দেখা যায় চকচকে চোখে লক্ষ্মীকুঞ্জের দিকে তাকিয়ে আছে। চ্যাঙড়া দরোয়ান রহমত ভাইকে দেখেছি হম্বতম্বি করতে.. যান যান যার যার কামে। বাদাইম্যার মতো খারায়া কী দেহেন? কইতাছি না স্যার নাই। তিনি শুটিংয়ে ককসোবাজার, আইজ ফিরত না তো..!
লোকজনের সামনে তো আর চুরি-চামারি করা যায় না। তাই মনে মনে ‘বাদাইম্যাদের’ আরও খারাপ খারাপ গালি দিয়ে আমরা হান্নান রাজাকারের বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতাম।
একদিন ইসলামিয়াত ক্লাসে বড় হুজুরের ঝিমানোর সুযোগে আমরা লাস্টবেঞ্চ একযোগে স্কুল ছাড়ি। কালবোশেখির মওসুম, টিপটিপ বৃষ্টি। তাতে কী, চলবে অপারেশন চৌর্যবৃত্তি। আজকের ভেন্যু গুলশান লেডিস পার্ক। মামুন, ওসমান, সাজ্জাদ আর আমি- চারজনের দলটি লক্ষ্মীকুঞ্জ ক্রস করার সময় থমকে গেলাম। ও আল্লাহ, কী তামশা! কোথাও কেউ নেই, আসলে ভোর থেকে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি তো..। একবার খালি একে অন্যের মুখের দিকে একনজর তাকালাম। তারপর লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম লক্ষ্মীকুঞ্জের বাউন্ডারিতে। কলাপাতা রঙা কচি আমগুলো বোটা থেকে ছিঁড়ে টপাটপ পকেটে ভরতে থাকলাম। আমাদের ‘দ্য থিফ’ টিমে ওসমান হচ্ছে স্পেশালিস্ট, খুব দ্রত সে যেকোনো গাছের মগডালে ওঠতে পারে। তাই তাকে আমরা বান্দর নামেও ডাকি। বান্দরটা করল কী, আমের সাইজ বড় দেখে লাফ দিয়ে ডাল ধরে গাছের উপরের দিকে ওঠতে লাগল। অমনি শুনি, ঘেউ ঘেউ! হায় হায়, রাজ্জাকের বড় ছেলে ‘ঢাকা-৮৬’ ছবির নায়ক বাপ্পারাজের অ্যালসেশিয়ানটার কথা আমাদের মনেই ছিল না।
ভাগ্য ভালো কুকুরটার গলায় শেকল আটকানো ছিল। ঘেউ ঘেউ করল কুকুর আর আমাদের দেখে ডান্ডা হাতে দারোয়ান রহমত এলো তেড়ে। আরে ধুর, মেজোরিটি আমরা, একজনের কী সাধ্য চারজনের সঙ্গে পারে! মগডালে থাকা ওসমানকে বললাম, ওরে বান্দর নামরে জলদি। স্কাউটের ট্রুপ লিডার সাজ্জাদ দারোয়ানের দিকে চোখ পাকিয়ে চিৎকার দেয়, সাবধানে দাঁড়াবে, সাবধান! থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল রহমত। ঘটনার নিয়ন্ত্রণ এ পর্যন্ত আমাদের হাতেই ছিল। কিন্তু এরপর যা ঘটল তার জন্য প্রস্তত ছিলাম না কেউ।
‘কীরে রহমত, কী হয়েছে? চিৎকার শুনলাম। এই কারা তোমরা?’
সাদা চুনকাম বাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন ধবধবে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরনে সেই নায়ক, যাকে দেখতে সিনেমা হলে দ্বিগুণ টাকায় ব্ল্যাকে টিকিট কাটতে হয়। আবহাওয়া খারাপের কারণে আজ তিনি শুটিংয়ে যাননি। আমাদের চারপাশের রঙিন জগত এক নিমিষে সাদাকালো হয়ে গেল। নায়করাজ রাজ্জাককে এভাবে দেখতে পাব এবং সরাসরি তার কাছে ধরা খাব, তা ছিল আমাদের কল্পনার বাইরে।
কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। ভেতর থেকে অনুভব করলাম আত্মরক্ষার তাগিদ। বাউন্ডারি থেকে একলাফে নেমে দে দৌড়। আমার দেখাদেখি সাজ্জাদ আর মামুনও ঝেড়ে দৌড়। এক দৌড়ে সোজা আজাদ মসজিদ। সিঁড়িতে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে সঙ্গীদের বললাম, বান্দরটা কই? সাজ্জাদ কিছু বলল না। মামুন কেঁদে ফেলল।
চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা দৃশ্য। ইয়া মোটা তাগড়া ভিলেন জসিমকে পিটিয়ে তক্তা বানাচ্ছে নায়করাজ। আর ওসমান তো তালপাতার সেপাই, আজকে বান্দরটার জান কেরোসিন। নিশ্চিত আম চুরির অপরাধে রাজ্জাক নিজের হাতে ওসমানকে পেটাবেন, তারপর তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেবেন। সর্বনাশ, কড়া ধোলাই খেয়ে নির্ঘাত বান্দর ওসমান আমাদের নামও নায়ককে বলে দেবে। আর নায়করাজ রাজ্জাক যদি স্কুলে বিচার দেন, তাহলে হেডস্যার খালেদ মোমিন আমাদের রেড টিসি দিয়ে বিদায় দেবেন। আর কোনো স্কুলে ভর্তি হতে পারব না, জীবনটাই হয়ে যাবে বরবাদ। এখন আমরা কী করতে পারি?
তিন সহপাঠী মিলে একমত হলাম, বাসায় আর ফেরা যাবে না। ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে বেড়াব আর বাদাম বিক্রি করব। সিদ্ধান্ত যখন চুড়ান্ত, ঠিক তখনই দেখতে পেলাম, আজাদ মসজিদের গেইট দিয়ে ওসমান ঢুকছে। কই পিটুনি খেয়ে তক্তা তো হয় নাই, বান্দরে আস্তই আছে। হাতে আবার একটা ছোট্ট চটের ব্যাগও দেখা যায়।
আমাদের পাশে এসে সিঁড়িতে বসে ওসমান। তারপর ব্যাগ থেকে টেনিস বল সাইজের একটা আম বের করল। দেখেই বুঝলাম পাকা। বান্দরটা আমটার নিচের দিকে একটা ফুটো করে চুকচুক করে চুষতে লাগল। আরে গাছের আম তো ছিল সব কাঁচা, পাকা আম পেলি কই? নায়কে দিসে, এই বলে আবারও আম চোষায় মনোযোগ দিল ওসমান। এইবার ওকে দিলাম ধাক্কা, এই বেডা কি হইছে বল। নাইলে তিনজন কিলিয়ে তোরে ভূত বানাব।
ওসমানের কথা থেকে যা জানতে পারলাম তা হলো, তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে যায় সে। রাজ্জাক এসে তাকে টেনে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরেন। আর লাঠি হাতে নেওয়ায় দারোয়ান রহমতকে কড়া ধমকও দেন। তারপর বাসার ভেতর থেকে চটের ব্যাগ ভর্তি পাকা আম এনে ওসমানের হাতে দিয়ে নায়করাজ বলেন, এভাবে অনুমতি না নিয়ে বা কথা না বলে কোনো কিছু করা ঠিক না। এমন আর কখনো করবে না। তোমরা যখন খুশি লক্ষ্মীকুঞ্জে আসবে, আমি দারোয়ান রহমতকে বলে দিচ্ছি।
এরপর ওসমান, মামুন বা সাজ্জাদ কেউ আর লক্ষ্মীকুঞ্জে গিয়েছিল কি না জানি না। ওদের কারও সঙ্গে আর যোগাযোগও নেই। আমি ঠিকই গিয়েছিলাম। ওই ঘটনার প্রায় ২০ বছর পর পেশাগত কাজেই লক্ষ্মীকুঞ্জে যাওয়া। একবার নয়, একাধিকবার এবং বার বার।
লক্ষ্মীকুঞ্জে শেষ গিয়েছি নায়করাজ মারা যাওয়ার দুবছর আগে। আমার সেই সময়ের কর্মস্থল পূর্ব-পশ্চিমের একটা অনুষ্ঠানে নায়করাজকে আনার জন্য। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এসেছিলেন। একমঞ্চে দুই বাংলার দুই মহানায়ককে আনার ইচ্ছে ছিল আমাদের। রাজ্জাক ভাই অসুস্থ ছিলেন তখন। আগে কনফার্ম করলেও বিকালে স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় ডাক্তার তাকে বের হতে নিষেধ করে দেন। ভেতর থেকে ঘুরে এসে নায়করাজের অসুস্থতার খবর দিলেন বয়সের ভারে নুয়ে পড়া তার এক সহকারী। তিনি আমাকে চিনতে পারেননি, কিন্তু সেদিনের সেই চ্যাঙড়া দারোয়ান রহমতকে চিনতে আমি ভুল করিনি।
[দ্রষ্টব্য : উপরের গল্পটির ৯০ শতাংশ সত্য ও বাস্তব, আর নাটকীয়তা আনতে ১০ শতাংশ রং লাগানো হয়েছে]
লেখক: ডেপুটি চিফ নিউজ এডিটর, আরটিভি