আরসা পানাহি। উত্তর-পশ্চিম ইরানের আরদাবিল শহরের ছাত্রী। ১৬ বছর বয়সী পানাহিকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী। আরসা সংখ্যালঘু আজেরি সম্প্রদায়ের মেয়ে। তার মৃত্যুর পরেই ইরানে প্রতিবাদ আরও প্রবল ও সংঘাতপূর্ণ হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, পুলিশ তাকে মারেনি। তার হৃদযন্ত্রের সমস্যা ছিল। এতেই সে মারা যায়।
২২ বছর বয়সী মাহসা আমিনির মৃত্যুর ক্ষেত্রেও একই যুক্তি দিয়েছিল পুলিশ। হিজাব না পরার অপরাধে পুলিশ যাকে ধরে নিয়ে যায় এবং পুলিশি হেফাজতে তার মৃত্যু হয়। তারপর বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে ইরান। মাহসার মৃত্যু নিয়ে বিক্ষোভের মধ্যেই আরসার মৃত্যুর খবর এসেছে। ফলে বিক্ষোভ আরও জোরদার হয়েছে।
পানাহির মৃত্যু নিয়ে জানা যায়, গত ১৩ অক্টোবর পুলিশ আরদাবিলের স্কুলে যায় এবং ছাত্রীদের ইসলামিক রিপাবলিকের প্রশস্তিতে গান গাইতে বলে। কয়েকজন শিক্ষার্থী গান গাইতে অস্বীকার করে। তাদের প্রচণ্ড মারধর করা হয়। আরসা ছিল তাদের মধ্যে একজন। শুক্রবার হাসপাতালে সে মারা যায়। আরসার মৃত্যুর খবর দাবানলের মতো ইরানে ছড়িয়ে পড়ে।
ইরানের রেভলিউশনারি গার্ডের ঘনিষ্ঠ সংবাদসংস্থা তাসনিম জানিয়েছে, আরসার কাকা বলেছেন, সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। কিন্তু এরপরই সুইমিং ফেডারেশনের ওয়েবসাইটের একটি তথ্য ভাইরাল হয়। সেখানে বলা ছিল, আরসা ১২ বছর বয়সে ওই অঞ্চলের সাঁতার প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয়েছে। পরে ওই তথ্য ফেডারেশনের ওয়েবসাইট থেকে মুছে ফেলা হয়।
আরদাবিলের মেয়র নতুন তত্ত্ব নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেছেন, আরসার বাড়িতে ঝামেলা চলায় সে ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে।
সাবেক ফুটবল প্লেয়ার আলি দায়েই ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন, আপনারা সত্যি কথা বলছেন না। আমি জানি আমার শহরে কী হয়েছে। ৫৩ বছর বয়সী আলি জার্মানির বুন্দেশলিগায় বেশ কয়েকটি দলের হয়ে খেলেছেন।
আরসার ঘটনাই প্রথম নয়, গত চার সপ্তাহ ধরে কর্তৃপক্ষ এরকম আরও কয়েকটি মৃত্যুর কথা অস্বীকার করেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ইরান বিশেষজ্ঞ রাহা বাহরেইনি বলেন, আমাদের কাছে এই তথ্য আছে যে, আরও তিনজন ছাত্রী পুলিশের মারের ফলে মারা গেছেন। তাদের মাথায় আঘাত করা হয়েছিল।
তাদের দাবি, ২০ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিক্ষোভ-সমাবেশে পুলিশের মারে ২৩ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক মারা গেছে। তার মধ্যে ২০ জন ছেলে, তাদের বয়স ১৭ থেকে ২০ বছরের মধ্যে এবং তিনজন মেয়ে। একটি মেয়ের বয়স ছিল ১৭, বাকি দুইজনের ১৬। ছেলেদের অধিকাংশই গুলি লেগে মারা গেছে। আর মেয়েদের মাথায় আঘাত করায় তাদের মৃত্যু হয়েছে।
বাচ্চাদের পরিবারকে পুলিশ ভয় দেখিয়ে বলেছে, তাদের বলতে হবে অসুস্থতার জন্য তারা মারা গেছে বা আত্মহত্যা করেছে।
১৭ বছর বয়সী নিকা শাহকার্মির মা জানিয়েছেন, সন্তানের মৃত্যুর পর তাদের ভয় দেখানো হয়েছিল। ইরানের কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিল, নিকা বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিল। তাতেই তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তার মা পরে বলেছেন, এ সবই মিথ্যা তথ্য। নিজেদের বাঁচানোর জন্য নিরাপত্তা বাহিনী এমনটা করছে।
ইরানে যে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলছে, তার সামনের সারিতে রয়েছে স্কুলছাত্রীরা। বিক্ষোভের সময় তাদের হিজাব পরতে দেখা যায়নি এবং এ সময় তাদের সরকার বিরোধী স্লোগান দিতে দেখা যায়। বিক্ষোভকারীদের এসব ছবি নেটমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
এই বিক্ষোভ দমন করার জন্য নিরাপত্তা বাহিনী স্কুলে যাচ্ছে। কখনও স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে খবর পেয়ে যাচ্ছে, কখনও অন্য সূত্রে খবর পেয়ে যাচ্ছে। সাদা পোশাকের পুলিশ অফিসাররা গিয়ে জোর করে স্কুলের ক্লাসে ঢুকে পড়ছে। তারপর ছাত্রীদের গ্রেপ্তার করছে।
কিছু ক্ষেত্রে স্কুলে কাঁদানে গ্যাসের সেল ছুড়ছে পুলিশ। সোমবার ইরানের টিচার্স ইউনিয়ন এভাবে ছাত্রীদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা বলেছে, অমানবিক ও বর্বরোচিতভাবে স্কুলে তল্লাশি করছে পুলিশ।