ঢাকারোববার, ২০ জুলাই ২০২৫, ৫ শ্রাবণ ১৪৩২

দাম্পত্য সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব উভয়ের

লাইফস্টাইল ডেস্ক, আরটিভি অনলাইন

বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারি ২০২০ , ০৫:৩১ পিএম


loading/img
ফাইল ছবি

কিছু কিছু দম্পতি মানসিক ও শারীরিকভাবে পরস্পর এতো বেশি বিচ্ছিন্ন অনুভব করে যে, তা সম্পর্কের ক্ষেত্রে সত্যিকারের তালাকের চেয়ে বেশি ক্ষতি করে। সারা বিশ্বে যুগলরা শোবার ঘরে দূরত্ব তৈরি হওয়া নিয়ে কথা বলা এড়িয়ে চলে থাকে। যদিও ওই যুগল এবং বৃহত্তর পরিবারের ক্ষেত্রে এই অবস্থা বাস্তবিক পক্ষে তালাকের চেয়ে বেশি ক্ষতি করে।

বিজ্ঞাপন

বিবিসি এ ধরনেরই কিছু যুগলের সঙ্গে যারা ‘আবেগ শূন্যতা’অনুভব করছেন তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেছে এবং থেরাপিস্টদের সঙ্গে এর সমাধানের বিষয়ে জানতে চেয়েছে।

 

বিজ্ঞাপন

বিয়ের পর আবেগের অভাব

৪৬ বছর বয়সী কামাল বলেছেন, সত্যি করে বলতে গেলে আসলে বলতে পারবো না যে আমি বিবাহিত নাকি তালাকপ্রাপ্ত। লন্ডনের টেলিযোগাযোগ বিষয়ক কনসালটেন্ট তার স্ত্রী থুরায়ার সঙ্গে ২০ বছর ধরে সংসার করছেন এবং তাদের দুটি ছেলে রয়েছে যাদের বয়সও ২০ বছরের কাছাকাছি।

৪৬ বছর বয়সী কামাল একজন সক্রিয় সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক যার ফেসবুকে শত শত ফলোয়ার রয়েছে। তবে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়ে জানান যে, অনেকটা মন্দা চলছে। প্রগাঢ় ভালোবাসা থেকে এটি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধে পরিণত হয়েছে। ঠিক যেমনটা কাজের জায়গায় দুজন সহকর্মী একে অপরের প্রতি যা অনুভব করে।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, এটা শুরু হয় যখন আমাদের প্রথম ছেলে জন্মগ্রহণ করে তখন। মনে হতো যে আবেগ ও যৌন আকর্ষণ জানালা দিয়ে পালিয়ে গেছে- এরপর থেকে এরকমই চলছে। ও যখন আলাদা ঘুমাতে চাইতো তখন আমি নানা অজুহাত খুঁজতাম, এমনকি আমাদের ছেলের জন্মের কয়েক মাস পরেও। আমি বলতে থাকতাম যে এটা হয়ত হরমোন বা প্রসব পরবর্তী মেজাজ পরিবর্তনের কারণে হয়েছে। আমি অনেক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছি। বিশেষ করে তখন, যখন এটা বেশ সময় ধরে চলছিল। আমাদের দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পর সে হয়ত আমাদের মধ্যে আর কোনো ধরনের আবেগময় বা যৌন সম্পর্ক চাইত না।

বিজ্ঞাপন

কামাল স্মৃতিচারণ করে বলেন, কিভাবে একদিন তার স্ত্রী তাকে বলেছিল, বাচ্চাদের মতো আচরণ বন্ধ করো’যখন সে বলেছিলেন যে তার রোমান্স দরকার, যখনই আমি তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছি, সে বলতো আমার একজন বাবার মতো আচরণ করা উচিত।

থুরায়া মনে করেন যে তিনি একজন আদর্শ স্ত্রী। কারণ তিনি বাচ্চাদের ও বাসার খেয়াল রাখেন এবং পুরো পরিবারকে আঁকড়ে রাখেন। ‘আমার মনে হয় একজন মা এবং একজন গৃহিণী হিসেবে সে খুব ভালো করছে কিন্তু সেটা সে পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।’

 

অনাকাঙ্ক্ষিত

কামালের হতাশা আরো বাড়তে থাকে। তিনি নিজেকে অনাকাঙ্ক্ষিত মনে করেন এবং তিনি দূরে সরে যেতে শুরু করেন। তিনি বাড়ি ফিরে এসে নিজের ঘরে আরাম করেন এবং ফেসবুকের শত শত বন্ধুর সঙ্গে ভার্চুয়াল জগতে সময় কাটান।

তাদের মধ্যে নারী অনুরাগীর সংখ্যা কম ছিল না, যারা তার চিন্তাকে পছন্দ করত। তিনি মাঝে মাঝে তার সঙ্গীতের যন্ত্র বাজিয়ে তা ফেসবুক পেজে পোস্ট করতেন। যখন অনেক বেশি ‘লাইক’ আসা শুরু করল তখন তিনি আবার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে শুরু করলেন, যা লাইক ও কমেন্ট দিয়ে শুরু হয়েছিল তা ধীরে ধীরে রোমান্টিক এবং যৌন সম্পর্কে পরিণত হতে শুরু করল, কামাল বলেন।

আমার বিয়েটা প্রাণহীন এবং আমি আবেগীয়ভাবে মৃত অনুভব করার সময় যখন আমার প্রতি আকর্ষণীয় নারীরা আগ্রহ দেখাত, তখন তা উপেক্ষা করা আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ত।

কামাল নিশ্চিত যে, তিনি শুধু একা এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন না, মানুষ হয়ত আমায় নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করবে, আমিই একমাত্র নই। আমার মতো আরো অনেকেই আছে- আমার পরিচিতজনদের মাঝেই তাদের সংখ্যা কম নয়।

ও একটি দ্বৈত জীবন গড়ে নিয়েছে, একদিকে সে একজন ‘আদর্শ বাবা ও স্বামী’অন্যদিকে ছুটির সময়ে তার ভালোবাসার সঙ্গে দেখা করে।

কোনো ধরনের অজুহাত না টেনে সমাজবিজ্ঞানী হামিদ আল হাশিমি মনে করেন, কামাল যদি তার স্ত্রীর সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করত যে তিনি কী চায় তাহলে সেটি তার জন্য বেশি ভালো হতো।

গুরুত্ব দেয়া না হলে পরিস্থিতি কোথায় যেতে পারে সে বিষয়ে তার স্ত্রীকে জানানো উচিত ছিল, আল-হাশিমি বলেন।

সবসময়ই সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে মাঝামাঝি একটি জায়গা ঠিক করে নেয়া; যা উভয়পক্ষের জন্যই সমঝোতার জায়গা, যা ভুল এবং ক্রমবর্ধমান একাকীত্ববোধকে কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে।

আল-হাশিমি জোর দিয়ে বলেন যে, উভয়পক্ষেরই দোষ রয়েছে। স্ত্রীরও উচিত নয় বৈবাহিক জীবনের আবেগময় এবং যৌন বিষয়টিকে উপেক্ষা করা- যা খুবই স্বাভাবিক বিষয় এবং যা ভালোবাসা ধরে রাখার জন্য জরুরি।

থেরাপিস্ট এবং কাউন্সিলর আমাল আল হামিদ মনে করেন, আমাদের যা করার ছিল তার সবই করেছি- এ ধরনের কথা বলা বন্ধ করতে হবে। অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রবণতা কারো জন্যই সুফল বয়ে আনে না, তিনি বলেন।

এর পরিবর্তে তিনি ভালো জিনিস নিয়ে ভাবার পরামর্শ দেন, যেমন আগের স্মৃতি এমন সময় যখন তারা একসঙ্গে কাজ করে কোনো প্রতিবন্ধকতা পার করেছিল।

প্রত্যেকেরই সম্পর্ক ভালো করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া উচিত। কারণ ইতিবাচকতা সংক্রামক, তিনি বলেন।

 

অপরাধ বোধ

মিত্রা ও রুস্তম- চল্লিশের কোটায় থাকা ইরানের দম্পতি। ২০০৫ সাল থেকে বার্মিংহামে তাদের দুই মেয়ের সঙ্গে বাস করেন তারা।

দশ বছর আগে জরায়ুর ক্যান্সারের সঙ্গে সঙ্গে স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা নেন মিত্রা। যার কারণে একটি স্তন, ডিম্বাশয় এবং জরায়ু হারাতে হয় তাকে। এ অবস্থাকে তাকে গভীরভাবে আঘাত করে তাকে শক্তিহীন এবং বিষণ্ণতায় ডুবিয়ে দিয়েছিল।

অস্ত্রোপচার তার জীবন ফিরিয়ে দিলেও তার যৌনজীবন শেষ করে দিয়েছিল। তিনি বলেন, এখন আমার একমাত্র স্বস্তি শুধু আমার দুই মেয়ে।

যখন তার স্বামী অন্য কোথায় ভালোবাসা খুঁজতে শুরু করে তখন তিনি এটা বিশ্বাসই করতে পারেননি। যখন তিনি জানতে পারেন যে তার স্বামী কী করছেন তখন তিনি স্বামীকে তার এবং অন্য নারীর মধ্যে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে বলেন। তিনি তাকেই বেছে নেন কারণ তিনি জানতেন যে, তিনি যদি অন্য নারীকে বেছে নেন তাহলে তাকে তার মেয়েদেরকেও হারাতে হবে।

যদি আর কোনো উপায় থাকত তাহলে শেষ পর্যন্ত আমি তার পাশে থাকতাম। কারণ বিয়ে ভালো ও মন্দ- উভয় সময়ের জন্যই। পুরুষদের হয়ত আরো কম স্বার্থপর হতে শিখতে হবে, তিনি বলে।

এখনও মিত্রা তার স্বামীর চাহিদা মেটাতে পারেন না এবং বলেন যে এর জন্য তিনি অপরাধ বোধে ভোগেন। তিনি আমাকে ত্যাগ করবেন আমি সেটাও মানতে পারবো না। নারী হিসেবে আমি অনাকাঙ্ক্ষিত অনুভব করা সহ্য করতে পারবো না।

এখন বই পড়ার মধ্যেই রুস্তম তার সান্ত্বনা খোজার চেষ্টা করেন। কাজ ছাড়া তিনি অন্য তেমন কিছুই করেন না। তিনি সবসময়ই চুপ থাকেন। এমনকি তার মেয়েরাও বলেন যে, তিনি বিরক্তিকর- মিত্রা বলে।

বৈবাহিক কাউন্সেলিংয়ের মারাত্মক প্রয়োজন থাকলেও, এশিয়া ও পশ্চিমা সম্প্রদায়ের মানুষেরা সেটা নিতে চায় না।

 

অর্থনৈতিক সহায়তা

২৯ বছর বয়সী সামার ২০১৫ সালে সিরিয়া থেকে তুরস্কে আসেন যেখানে শরণার্থীর জীবন বিশেষ করে নারী শরণার্থী যাদেরকে প্রায়ই হয়রানির মুখে পড়তে হয় তার অবসান করতে তিনি একজন তুর্কি পুরুষকে বিয়ে করেন।

তিনি মনে করেছিলেন যে, বিয়েই হচ্ছে একমাত্র পরিশীলিত সমাধান। কিন্তু তিনি বিস্ময়ের মুখে পড়ে যখন তিনি জানতে পারেন যে তার স্বামীর পরিবার ও সামাজিক অবস্থা তার নিজের তুলনায় অনেক আলাদা।

তিনি বলেন, আমার পুরো জীবন বাচ্চাদের খেয়াল রাখা, রান্না করা, পরিষ্কার করা এবং তার (স্বামীর) চাহিদা পূরণেই কেটে যাবে। এমন একজন ব্যক্তিকে যে নিজের অনুমতি ছাড়া নারী প্রতিবেশিদের সঙ্গেও দেখা করতে যেতে দেয় না। বিয়ে করার একমাত্র কারণ ছিল আর্থিক সহায়তা, যা তার দুই সন্তানকে দেখাশোনার জন্য জরুরি।

যদি আমার অন্য কোনো উপায় থাকত তাহলে তার সঙ্গে আমি একদিনও থাকতাম না। আমার পরিবারের সঙ্গে থাকার সময় আমার সঙ্গে কেউ এমন ব্যবহার করেনি। আমার মতামত, মর্যাদা, অনুভূতির কোনো মূল্য নেই এখানে। সে যা চায় তা হলো ইচ্ছানুযায়ী যৌন চাহিদা পূরণ করা।

 

গোপনে বিয়ে

ইরবিলের রৌজ বলেন, তার ৬০ বছর বয়সী বাবা ৪৭ বছর বয়সী মায়ের সঙ্গে কয়েক দশক ধরে ঘুমায়নি। তার মা জানেন যে, তার বাবা গোপনে অন্য নারীকে বিয়ে করেছেন কিন্তু পুরো বিষয়টিই তিনি ঢেকে রাখতে চান। যদি এটি জানাজানি হয় তাহলে তিনি এ নিয়ে কানাঘুষা সামাল দিতে পারবেন না।

রৌজ বলেন, আমার বাবা একজন ধনী মানুষ এবং এ কারণেই ৩০ বছর বয়সী একজন তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন। আমার মা বলিষ্ঠ চরিত্রের এবং আর্থিকভাবে স্বাধীন কিন্তু সম্মান রক্ষার জন্য তিনি এ নিয়ে কথা বলতে চান না বা তালাক চান না। তিনি তার সম্মান বজায় রাখতে চান ।

বছরের পর বছর ধরে তার মা মানসিক যাতনা সহ্য করে গেছেন কিন্তু তিনি এটি গোপন রাখেন কারণ তিনি নিজেকে দুর্বল দেখাতে চান না, রৌজ বলেন। তিনি দেখান যে, তিনি ভালো আছেন এবং সুখী কিন্তু বাস্তবে তিনি অনেক দুঃখী।

তার মা এ বিষয়ে আইনি সহায়তা নিতেও রাজি হননি কারণ তিনি তার স্বামীর বিয়েকে গোপন রাখতে চান।

 

ফিরে আসার সম্ভাব্য উপায়

কাউন্সিলর আল হামিদ মনে করেন, সম্পর্ক ভালো করতে হলে দুজনেরই সেটি সারিয়ে তোলার জন্য প্রবল ইচ্ছা থাকাটাই একমাত্র উপায়।

যদি তাদের মধ্যে একজনও অন্যজনকে কোণঠাসা করে ফেলেন, আপত্তি তোলেন, তাহলে সেটি শুধু খারাপই হবে। তাদের খোলামেলা কথা বলতে হবে এবং সেসময় শব্দ চয়ন সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। তা না হলে তারা পুরোপুরি বিপর্যয়ের মুখে পড়বেন।

আল-হামিদ বলেন, অনেক সময় একপক্ষ শুধু সবকিছু ঠিক করতে চায় কিন্তু অন্যপক্ষ আগের মতোই থাকে এবং পরিবর্তনের যেকোনো প্রচেষ্টাকেই ব্যর্থ করে দেয়।

যেকোনো সমস্যা কাটিয়ে উঠতে, দুই পক্ষকেই শিখতে হবে যে কিভাবে কোনো ঘটনা বাড়তে না দেয়া যায়। তাদের প্রায়ই কথা বলতে হবে, আপত্তিকর কোনো শব্দ বলা যাবে না- বলেন আল হামিদ। এমন আচরণ সবসময়ই পরিবর্তন আনতে সহায়তা করে- তিনি বলেন।

যদি স্বামী তার স্ত্রীকে কোনো উপহার দিয়ে অবাক করে না দেয় তাহলে সে কাজটি স্ত্রীকেই প্রথমে শুরু করতে হবে। সবসময় পদক্ষেপের জন্য বসে না থেকে তা শুরু করে দিলে সেটি অনেক বেশি কার্যকর হয়- তিনি বলেন।

তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে কখনোই হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না, চেষ্টা করে যেতে হবে।

 

সূত্র: বিবিসি বাংলা

 

এস

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন
Advertisement
Advertisement

Loading...


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |