বিবিসির বিশ্লেষণ
গণতান্ত্রিক নেত্রী থেকে যেভাবে শেখ হাসিনা ‘স্বৈরাচার’
আয়রন লেডি বলে শেখ হাসিনাকে মনে করেছিলেন অনেকে। এমন একজন প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে সেটি অনেকে ধারণাই করতে পারেননি। সাড়ে ১৫ বছরের সেকি দোর্দণ্ড প্রতাপ। বাংলাদেশের ইতিহাসে ক্ষমতাচ্যুত হবার পর কোনো ব্যক্তি এভাবে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হননি।
সোমবার (৫ আগস্ট) ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার সংসদও ভেঙে দেওয়া হয়। এর পরেই খুলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পথ।
বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর এত দিন টানা দেশ শাসন করেছেন তিনি। এর আগে ১৯৯৬ সাল থেকে এক মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা।
সব মিলিয়ে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসন চলেছে। তাই তাঁর মতো একজন প্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রীর এমন পতন ও দেশত্যাগের ঘটনা অবাক হওয়ার মতো বিষয় বটে।
তবে টানা ক্ষমতার শেষের দিকে এসে শেখ হাসিনা ক্রমেই স্বৈরাচারী মনোভাবের হয়ে উঠেছিলেন বলে মনে করেন সমালোচকেরা। বিশেষ করে ভিন্নমতের কাউকে তিনি গ্রাহ্য করতেন না। একের পর এক রাজনৈতিক গ্রেপ্তার, গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন—সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এসবই ছিল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ।
এ বছরের জানুয়ারিতে নজিরবিহীন এক নির্বাচনে জিতে চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। প্রধান বিরোধী দলগুলোর বর্জনের পরও এই নির্বাচন করায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আদালতের মাধ্যমে বারবার ‘আইনি হয়রানি করা হচ্ছে’—শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে এটা ছিল বড় একটি অভিযোগ। চলতি বছরের শুরুতে ড. ইউনূসের কারাদণ্ড হয়। তবে সমালোচকেরা মনে করেন, এই নোবেলজয়ী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার।
শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালে এক সেনা অভ্যুত্থানে বাবা–মা ও পরিবারের বাকি সদস্যদের হারান তিনি। বিদেশে থাকায় ভাগ্যক্রমে দুই বোন হাসিনা ও রেহানা বেঁচে যান। টানা রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিদেশে নির্বাসিত জীবন কাটে দুই জনের।
১৯৮১ সালে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। হাল ধরেন আওয়ামী লীগের। তখন জেনারেল এরশাদের শাসন চলছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে হাতে হাত ধরে গণ–আন্দোলনে নামেন শেখ হাসিনা। ১৯৯১ সালের নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনে হেরে যায় আওয়ামী লীগ। তবে অপেক্ষা করতে হয়নি বেশিদিন। ১৯৯৬ সাল নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। প্রথম মেয়াদে অন্তত দুটি কারণে আলোচিত হন শেখ হাসিনা। এক. ভারতের সঙ্গে গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি। দুই. পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা দূর করতে শান্তি চুক্তি করে। একই সময়ে বেশ কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়িক চুক্তি সই ও খুবই ভারতপন্থী মনোভাবের কারণে সমালোচনার মুখে পড়ে শেখ হাসিনা।
এসব কারণে ২০০১ সালে বিএনপির কাছে নির্বাচনে পরাজিত হয় আওয়ামী লীগ। এর পরেই ২০০৯ সালে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে দলটি। সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ওই নির্বাচন হয়েছিল। ২০১৪ সালে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নির্বাচন বর্জনের পর ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংসদ সদস্যকে নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সবগুলো দল অংশ নিলেও রাতের আধারে ব্যাপক ভোট কারচুপির মাধ্যমে ফের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় দলটি। ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি না আসায় বিভিন্ন আসনে ডামি প্রার্থী দাঁড় করিয়ে বিজয়ী হয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।
পর পর কয়েকবার বিতর্কের মুখে ক্ষমতায় আসার পর এবারই গুরুতর আন্দোলনের মুখোমুখি হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সূত্রপাত। পরে ব্যাপক রক্তপাতের পর সেটা এক দফা বা সরাসরি সরকারের পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়।
আন্দোলন দমনে কঠোর পথ বেছে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি আন্দোলনকারীদের সরাসরি ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। পুলিশ নির্বিচার গুলি চালায়। নিহত হন শত-শত মানুষ। এরপর হাজার হাজার মানুষকে ফৌজদারি অপরাধে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
তবে শুধু কোটা সংস্কারের দাবি নয়, করোনা–পরবর্তী সময়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জীবনযাত্রার বাড়তি ব্যয়ের কারণে ক্ষুব্ধ ছিলেন সাধারণ মানুষ। মূল্যস্ফীতি আকাশ ছুঁয়েছে। ব্যাপক ধস নেমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও। ২০১৬ সালের পর বিদেশি ঋণ দ্বিগুণ হয়েছে।
সমালোচকদের দৃষ্টিতে, শেখ হাসিনার সরকারের অব্যবস্থাপনার কারণে চারপাশ থেকে এমন ভরাডুবি হয় হাসিনার। এ ছাড়া কয়েক দশকের অর্থনৈতিক উল্লম্ফনের জেরে তার ঘনিষ্ঠজনদের সীমাহীন দুর্নীতির কারণেও মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর কর্তৃত্ববাদী দমন–পীড়নের অভিযোগ বেশ পুরনো। অথচ তিনি একসময় বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য রাজনীতি করে এসেছেন।
অধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, শেখ হাসিনার আমলে (২০০৯ সালের পরবর্তী সময়ে) বাংলাদেশে অন্তত ৬০০ গুমের ঘটনা ঘটেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে শতাধিক। এই আমলে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর একের পর এক আটক, নির্যাতনের অভিযোগ নতুন নয়। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। বাদ যায়নি মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকেরাও। তাদের আটক, নজরদারি, হয়রানিও করা হয়। গণমাধ্যমকে চেপে ধরতে শেখ হাসিনার সরকার কঠোরতর আইন করে।
এর বাইরেও শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে এটা ছিল বড় একটি অভিযোগ করা হয়- নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আদালতের মাধ্যমে বারবার ‘আইনি হয়রানি করা হচ্ছে’। চলতি বছরের শুরুতে ড. ইউনূসের কারাদণ্ড হয়। তবে সমালোচকেরা মনে করেন, এই নোবেলজয়ী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার।
এ বছরের নির্বাচনের আগে বিএনপির বহু জ্যেষ্ঠ নেতাকে আটক করা হয়। আটক হন দলটির হাজারো নেতা–কর্মী। এসব কর্মকাণ্ডকে শেখ হাসিনার ভিন্ন মতামত দমনের কৌশল হিসেবে ধরা হয়।
তবে এসব অভিযোগ বরাবর অস্বীকার করে আসলেও, শেখ হাসিনা অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে এবং তা নিয়ে প্রতিবেদন করার জন্য বিদেশি সাংবাদিকেরা বাংলাদেশ ভ্রমণ করতে চাইলে কখনোই অনুমতি দেয়নি। এসবের ফল এখন ভোগ করতে হচ্ছে শেখ হাসিনা এবং তার ৭৫ বছরের পুরানা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে।
মন্তব্য করুন