৩২ ধারা নিয়ে যেসব বিতর্ক
ধারাবাহিক প্রতিবাদের মুখে বাতিল করা হয়েছে বিতর্কিত তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা। তবে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারার মাধ্যমে নতুন খড়গ নেমে আসছে। এই আইনের বিরুদ্ধে ক্রমশ বাড়ছে ক্ষোভ। এ নিয়ে আতঙ্কে আছেন গণমাধ্যমকর্মীরা।
মানবাধিকার ও গণমাধ্যমকর্মীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতারাও এই আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হচ্ছে এর তীব্র সমালোচনা। আইনটি জাতীয় সংসদে পাস করার আগে চূড়ান্ত খসড়াটির এই ধারাসহ বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গেলো সোমবার মন্ত্রিসভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদন করা হয়। এর মাধ্যমে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিল করলেও নতুন আইনে ৫৭ ধারার বিষয়বস্তুগুলো চারটি ধারায় ভাগ করে রাখা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মানহানি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো-সংক্রান্ত বিষয়গুলো একত্রে ছিল।
--------------------------------------------------------
আরও পড়ুন: হেলালসহ বিএনপির ৫৮ নেতাকর্মীর রিমান্ড মঞ্জুর
--------------------------------------------------------
নতুন আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ।
এতে বলা হয়, এ অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। কেউ যদি এই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করেন, তাহলে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, সরকারের উচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি আরো সময়োপযোগী করা। সাংবাদিকরা এটি নিয়ে যে শঙ্কা প্রকাশ করছেন, তার সমাধান না করে সংসদে আইন আকারে পাস করা হলে এটির অপপ্রয়োগ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আরটিভি অনলাইনকে বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা সাংবাদিকতার জন্য একটি উটকো ঝামেলা সৃষ্টি করবে। খসড়াটি সংশোধন না করে যদি আইন আকারে পাস হয়, তাহলে তা পর্যালোচনা করা হবে। পর্যালোচনা করে তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া যাবে কি না তা নিয়েও আলোচনা করা হবে।
এ বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলেছে, ৩২ ধারা সাংবাদিক, লেখকসহ তথ্য সংগ্রহের কাজে যুক্ত পেশাজীবীদের কর্মক্ষেত্র সংকুচিত করবে বলে আশঙ্কা আছে। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বিলুপ্তির ঘোষণা হলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার ২৫, ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় আইসিটি আইনের অনুরূপ বক্তব্য যুক্ত করা হয়েছে। এই আইন নাগরিকের মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রবণতা তৈরি করবে।
আসক আরো বলেছে, আইনটি কার্যকর করার আগে এর বিভিন্ন ত্রুটি সংশোধনে রাষ্ট্রের উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়া উচিত। নাগরিকের মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রকে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে এই মানবাধিকার সংগঠন।
প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কে জনগণের বাক ও মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার ও সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক কনভেনশনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আখ্যায়িত করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এ আইনের সব বিতর্কিত ধারা সংশোধন এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনের অভিমতের ভিত্তিতে পরিমার্জনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এই আহ্বান জানান।
এ আইন নিয়ে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোও। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা ছিল কালো আইন। ওই আইনের কোথায় কোথায় সংশোধন করতে হবে সে বিষয়ে সুপারিশ ও পরামর্শগুলোর তোয়াক্কা না করে বিপরীতমুখী নতুন বিধান যুক্ত করে এবং বিচ্ছিন্ন ধারাগুলো এক জায়গায় করে আইন হচ্ছে। কালো আইন দূর হবে আশা করেছিলাম, কিন্তু সরকার কালো আইনের বদলে কুচকুচে কালো আইন জাতিকে উপহার দিচ্ছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন “একটি কালো আইন” হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এতে সাংবাদিকরাই বেশি হয়রানির শিকার হবেন। এটি পাস হলে মানুষের বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলেও কিছুই থাকবে না। সরকারের দুর্নীতি যাতে প্রকাশ না পায় বা কেউ প্রকাশ করতে না পারে সেজন্য এই আইন করা হয়েছে। ৫৭ ধারার মতো এ আইনেও সাংবাদিকরা হয়রানির শিকার হবেন। গণতন্ত্রকামীরাই ক্রিমিনাল হিসেবে চিহ্নিত হবেন এই আইনে। ফিরে যাওয়া হবে মধ্যযুগের অন্ধকারে।’ তিনি এই আইন সংসদে পাস করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান।
তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এসব শঙ্কাকে নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলছেন, গুপ্তচরবৃত্তি তো আগেও আইনে অপরাধ ছিল। এ আইনের মধ্যে যেটা করা হয়েছে সেটা হলো, কম্পিউটার সিস্টেম বা ইনফরমেশন টেকনোলজির সিস্টেমের মাধ্যমে যদি কেউ গুপ্তচরবৃত্তি করে, সেটা অপরাধ হিসেবে ধরা হয়েছে। এটার সঙ্গে সাংবাদিকতার কোনো সম্পর্ক আছে বলে তাঁর মনে হয় না।
তিনি বলেন, এটা অহেতুক ভীতি। বরং এই আইনের কারণে ৫৭ ধারার যে অপপ্রয়োগ হচ্ছিল, সেটা বন্ধ হবে।
এই আইনে কারও বাক্স্বাধীনতা হরণ হয়নি বলেও উল্লেখ করেন আইনমন্ত্রী।
আরও পড়ুন:
এসজে
মন্তব্য করুন