‘সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা শুধু আছে, সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই
একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুড়ি শুধু সেই দিনের মালি নেই।
কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউজে কত স্বপ্ন ঢেকে যায়, কতজন এলো গেলো কতজনই আসবে, কফি হাউজটা শুধু থেকে যায়।’
ওপরের লাইনগুলো মান্না দে’র বিখ্যাত ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানের শেষ চার লাইন। হ্যাঁ সেই কফি হাউজ আছে, পেয়ালা আজও খালি নেই। কতজন আসছে যাচ্ছে শুধু কফি হাউজটাই স্বগর্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শত বছরে কত মানুষ এলো গেলো, কত আড্ডা হলো কিন্তু যাদের নিয়ে এ গান তারা আজ আর নেই।
মান্না দে’ ও নেই। তবে কেউ থাকুক আর নাই থাকুক, আজও এ কফি হাউজ কলকাতাই শুধু নয় পুরো ভারতবর্ষের মানুষের কাছে জনপ্রিয়।
বাঙালির প্রাণের এ আড্ডাস্থলটির নাম কিন্তু এক সময় কফি হাউজ ছিলো না। ১৮৭৬ সালের এপ্রিলে তৎকালিন ব্রিটিশ রানি ভিক্টরিয়ার স্বামী আলবার্টের নামে নামকরণ করা হয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে নানা আন্দোলনের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে এ কফি হাউজ-এ।
১৯৫৭ সালে কফি হাউজটি ইন্ডিয়ান কফি বোর্ডের আওতা থেকে বেরিয়ে শ্রমিক সমবায় সমিতির অধীনে আসে।
উত্তর কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের একটু সামনেই এ কফি হাউজ। তিনতলা ভবনের দো’তালয় উঠলেই চোখে পড়বে কফি হাউজ লেখা সাইনবোর্ড টি। ছিমছাম খুব সাধারণ একটি রেস্টুরেন্ট। দেয়ালে টাঙানো ভারতবর্ষের বিখ্যাত শিল্পীদের চিত্র।
তবে কফি হাউজটিকে যে এখনো বাঙালি প্রাণবন্ত করে রেখেছে তা ঢুকলেই বোঝা যায়। কফি হাউজটি এখনো কানায় কানায় পূর্ণ থাকে সব সময়।
চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটি টেবিল ভর্তি লোকে থাকে। ভেতরে প্রবেশ করা মাত্রই দেখা যায় সাদা শেরওয়ানি ও মাথায় পাগড়ি দেওয়া বেয়ারাদের দৌড়াদোড়ি। সব বেয়ারা যেন কফি হাউজের মতো বয়ষ্ক।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন রোববার বাদে কফি হাউজটি প্রতিদিন খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। আর ছুটির দিন খোলা থাকে সকাল ৯ টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা এবং বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। এক কাপ চায়ের দাম ১৬ টাকা থেকে শুরু।
একজন বৃদ্ধ জানান, এখানে এলেই তার পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে। যেন জলজ্যান্ত সেসব দিনের ছবি তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কত আড্ডাই না দিতেন আগে এখানে। এখন আর তা হয়ে ওঠে না। সবার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। কেউ কেউ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। তবুও তিনি চেষ্টা করেন মাঝে মাঝে এখানে এসে স্মৃতিচারণ করতে। একটু পেছনে ফিরে যেতে।
কলেজে পড়া তরুণ থেকে শুরু করে সত্তোর্ধ বয়ষ্ক পর্যন্ত দেখা যায় আড্ডা দিতে। প্রতিটা চায়ের চুমুকে চলে ভিন্নরকম গল্প আর আড্ডা।
কফি হাউজটির পাশেই রয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও প্রেসিডেন্সি কলেজ। তাই বোধ হয় শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভিড় থাকে সব সময়ই। তবে সবাই যে ঐতিহ্য আর ভালোবাসার টানেই আর আট দশটা কফি হাউজ রেখে এখানে আসেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মহাত্মা গান্ধী, অমর্ত্য সেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো অনেক বাঙালি বুদ্ধিজীবী-কবিদের এক সময়ের আড্ডাস্থল ছিলো এ কফি হাউজ।
বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়, অভিনেতা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের মতন মানুষেরাও নিয়মিত আড্ডা দিতেন এ কফি হাউজে।
সেই বিখ্যাতদের কাতারে ক্ষণিকের জন্য হলেও নিজেকে ভাবতে আজও ছুটে আসেন বর্তমান সময়ের শিল্পী, বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ মানুষ।
তরুণ প্রজন্ম আসে স্মৃতিবিজাড়িত এ কফি হাউজে সময় কাটাতে কেউ বা আসেন বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্মরণে। দেশ বিদেশের অনেক পর্যটক আসেন মান্না দে’র টানে।
মান্না দে’ আজ নেই, উনার সঙ্গী সুজাতা, মইদুল, অমল, রমা রায় কেউ আজ নেই, শুধু রয়ে গেছে কফি হাউজটিভ। আর রয়ে গেছে মান্না দে’র গানটি। কফি হাউজের আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই।
ওয়াই/এমকে