ঢাকাবৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ভারত আর চীনের কাছে কোণঠাসা দেশীয় পাদুকা শিল্প

জয়নুল আবেদীন, চট্টগ্রাম

শনিবার, ০৩ জুন ২০১৭ , ০৬:৩৫ পিএম


loading/img

রমজান এলেই বন্দরনগরী চট্টগ্রামের মাদারবাড়ি এলাকায় পাদুকা (জুতা) কারখানাগুলোতে বেড়ে যায় ব্যস্ততা। পাদুকা শ্রমিকরা ধুপধাপ শব্দের মধ্যে দিয়ে দিন পার করেন। কেবল দিনে নয় গভীর রাত পর্যন্ত চলে শ্রমিকদের জুতা তৈরির ব্যস্ততা।  রমজানে হাতে তৈরি এসব জুতার চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকায় কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের এক মুহূর্তের ফুরসত নেই।

বিজ্ঞাপন

জুতা তৈরি হতে না হতেই ডেলিভারি দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেন কারখানার মালিকরা। বছরের অন্যান্য সময় তেমন কাজ না থাকলেও ঈদের সময় এলেই বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠেন জুতার কারখানার মালিক ও শ্রমিকরা।

নগরীর পূর্ব মাদারবাড়ি এবং পশ্চিম মাদারবাড়ি এলাকায় প্রায় ৬ শতাধিক হাতে তৈরি জুতা তৈরির কারখানা রয়েছে। এক সময় ৮ শতাধিক কারখানা থাকলেও এখন তা কমে এসেছে।  ভারত ও চীনের তৈরি জুতা বাজারে সয়লাব হয়ে যাওয়ায় হাতে তৈরি জুতার চাহিদা দিনের পর দিন কমে আসছে। ব্যবসার উপযুক্ত পরিবেশ, অর্থাভাব ও শ্রমিকদের সময়োপযোগী মজুরি দিতে না পারায় একের পর এক বন্ধ হয়ে গেছে অনেক কারখানা।

বিজ্ঞাপন

আবার অন্য কোনো পেশায় পারদর্শিতা না থাকায় লাভ ক্ষতি মিলিয়ে এ পেশায় জড়িত রয়েছে অনেকে মালিক ও শ্রমিক।

নগরীর মাদারবাড়ি থেকে তৈরি জুতা রিয়াজুদ্দিন বাজার নুপুর মার্কেটেই বেশি সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি নগরীর বিভিন্ন পাইকারি দোকানেও সরবরাহ করা হয়। রমজান এলেই পাইকারি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কারখানায় গিয়ে জুতার অর্ডার দিয়ে আসে। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী জুতা তৈরি করে সরবরাহ করেন এসব জুতা কারখানার মালিকরা। 

ছোট ছোট খুপরির মতো দোকান নিয়ে চলছে এ জুতার কারখানা তৈরি। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় একই দোকানের একটু উঁচুতে শক্ত মাচা তৈরি করে সেখানেও কাজ করছে জুতা শ্রমিকরা। রমজান এলেই এসব কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যায়।

বিজ্ঞাপন
Advertisement

নগরীর পূর্ব মাদারবাড়ি মালুম মসজিদ এলাকায় ৮ বছর ধরে হাতে জুতা তৈরি করে আসছেন বাবুল নামে এক ব্যবসায়ী। বাড়ি মানিকগঞ্জ। তার কারখানায় শ্রমিক রয়েছে ৬ জন। রমজান ছাড়া অন্য সময় ২/৩জন দিয়ে চালন কারখানা। হাতে তৈরি জুতার বাজারে কেমন চাহিদা জানতে চাইলে তিনি আরটিভি অনলাইনকে জানান, আগেতো বেশ ভালোই ছিল। বর্তমানে চীন ও ভারতের তৈরি জুতা বাজার দখল করেছে। আমাদের তৈরি জুতার চাহিদা কমে গেছে। রমজানে এক মাসে ১৩০ ডজন জোড়া  জুতা তৈরি করে সরবরাহ করতে পারেন বলে জানান তিনি। অন্য সময় ৬০ ডজন জুতা সরবরাহ করে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। চীন আর ভারত মেশিনে তৈরি করায় এদের জুতায় একটু ফিনিশিং থাকে। পুঁজির অভাবে আমাদের হাতে তৈরি করায় ফিনিশিংটা ভাল হয় না। ফলে ক্রেতারা চীন ও ভারতের জুতার প্রতি ঝুঁকে বেশি।

এক সময় জুতা শ্রমিকের কাজ করার পর এখন পুরোদমে কারখানার মালিক হাবিবুর রহমান। ১০ বছর ধরে তার কারখানা চলছে। বেশিরভাগ জেন্টস জুতা তৈরি হয় তার কারখানায়। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন পুরো বছর বলতে গেলে ক্ষতিই থাকে বেশি। রমজানে কিছুটা লাভের মুখ দেখি। ১০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি ব্যাংক থেকে। ভারত আর চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে হচ্ছে। ১২ জন শ্রমিক মিলে দিনে আমরা হাতে তৈরি করি ১৬ ডজন জুতা। আর মেশিনে তৈরি করতে পারে তার সাতগুণ। স্বাভাবিকভাবে উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় ভারত ও চীনের জুতা আমাদের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে পারে। তারপরেও বিদেশী জুতা বলে ক্রেতাদের কাছ থেকে বেশি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা।

তিনি বলেন, আমার কারখানায় মেশিনে জুতা তৈরি করতে হলে কমপক্ষে  ৩ কোটি টাকা দরকার হবে। আর এই মেশিন দিয়ে কেবল দেশে নয় বিদেশেও রপ্তানি করার মতো জুতা আমরা তৈরি করতে পারবো। সেই আস্থা আমাদের আছে। কম সুদে সরকারিভাবে অর্থায়নের সুযোগ পেলে বিদেশ থেকে আর জুতা আনতে হবে না। বরং জুতা রপ্তানি করা যাবে। 

তিনি আরো বলেন, এক সময় এই এলাকায় অসংখ্য হাতে তৈরি জুতার কারখানা ছিল। পুঁজির অভাব আর চীন-ভারতের জুতা মার্কেট দখল করায় ক্ষতি পোষাতে না পেরে কারখানা ছেড়েছে অনেকে।

এ শিল্পের শ্রমিকদেরও রয়েছে নানা বঞ্চনার কথা। ইয়াছিন নামের এক শ্রমিক আরটিভি অনলাইনকে জানায়, গেলো ৪বছর আগে শ্রমিকের যে মজুরি ছিল এখনও তা রয়েছে। এক ডজন জুতা তৈরি করতে পারলে ৩শ টাকা মজুরি পাই। দৈনিক ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করে ২ ডজন জুতা তৈরি করা যায়। রমজান এলেই ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ থাকে। অন্য সময় চাহিদা কম থাকায় ১ ডজন জুতা তৈরি করেই বসে থাকতে হয়। ফলে পরিবার নিয়ে এক কথায় না খেয়ে বেঁচে আছি। 

আরেক শ্রমিক জমির ১৪ বছর ধরে জুতা তৈরির কাজ করছেন। তিনি জানান ছোট বেলা থেকে এই কাজ শিখেছি। এই কাজ ছাড়া আর কিছুই শিখেনি। এখন মজুরি কম হলেও এ কাজ করেই কোনো রকম চলছি। তিনি অভিযোগ করেন, চীন-ভারত আমাদের ভাগ্যের উপর হানা দিয়েছে। এক সময় চাহিদা ছিল বিধায় আমাদের উপার্জনও ভালো হতো। এখন ভারত আর চীনের জুতা বাজার দখল করায় হাতে তৈরি জুতার চাহিদা কমে গেছে। তিনি বলেন, দিনমজুরী করলেও দৈনিক ৫শ’ টাকা পাওয়া যায়। আর আমাদের এই পেশায় কষ্ট বেশি আয় কম।

চট্টগ্রাম পাদুকা শিল্প মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুম মুনির সাকিব আরটিভি অনলাইনকে জানান, এ পেশায় এক সময় জৌলুস ছিল। এখন আর সেটা নেই। ভারত-চায়না সব জৌলুস কেড়ে নিয়েছে। এক দিকে ভারত আর চীনের জুতার আগ্রাসন অন্যদিকে পাইকারি বাজারগুলোতে ব্যবসায়ীরা কারখানার মালিকদের টাকা আটকে রাখার কারণে অনেক কারখানার মালিক পুঁজি হারিয়ে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছে।

তিনি বলেন, হাতে তৈরি জুতার কারখানার সুদিন ফিরিয়ে আনতে চট্টগ্রাম চেম্বারের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। চীন আর ভারত থেকে জুতা আমদানি বন্ধ করার দাবি জানিয়েছি। হাতে তৈরি জুতার কারখানার মালিক শ্রমিকের সুদিন ফিরিয়ে আনতে হলে এ কাজটি করতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হলে চট্টগ্রামের পাদুকা (জুতা) শিল্প ফের ঘুরে দাঁড়ানোর পাশাপাশি এ শিল্প দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এসএস

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন
Advertisement
Advertisement

Loading...


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |