বিশ্বব্যাপী যেন শুল্কের পাগলা ঘোড়া ছুটিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দিন তিনেক বাদেই কার্যকর হতে যাচ্ছে তার নতুন শুল্কনীতি, যেখানে বিভিন্ন দেশের রপ্তানিপণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক চাপিয়েছেন তিনি। চীন-ভিয়েতনাম-ভারতের মতো এ তালিকায় আছে বাংলাদেশও। এ নিয়ে মার্কিন বাজারনির্ভর অনেক দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশেও চলছে তোলপাড়।
অবশ্য, এমনটাই হওয়ার কথা! বাংলাদেশের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র। দেশের তৈরি পোশাকের একটি বড় অংশ রপ্তানি করা হয় দেশটিতে। সেখানে ট্রাম্পের বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্কারোপের ঘোষণা স্বাভাবিকভাবেই বড় এক ধাক্কা হয়ে এসেছে দেশের রপ্তানি খাতে; বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে। দ্রুতই কোনও পদক্ষেপ না নেওয়া গেলে রপ্তানি আয়ে ধাক্কার পাশাপাশি অচিরেই ভারতের কাছে নিজেদের প্রধান বাজারটি হারাতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন দেশের রপ্তানিকারকরা।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২ এপ্রিল নির্বাহী আদেশে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাতে পণ্যভিত্তিক শুল্ক হারের তালিকা বা কাস্টমস গাইডেন্স দেওয়া হয়নি। হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই আদেশের দ্বারা নির্ধারিত শুল্কের হারগুলো প্রযোজ্য অন্য কোনো শুল্ক, ফি, কর বা চার্জের অতিরিক্ত। তবে, তারা দেশ বা পণ্য অনুসারে আর কিছু জানায়নি।
এর ফলে অতিরিক্ত এ শুল্কারোপ নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি খাতে। অতিরিক্ত শুল্ক কার্যকরের পর বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকরা ঠিক কী পরিমাণ শুল্কের মুখোমুখি হবেন, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তারা এখনও জানেন না, নতুন শুল্ক হার বর্তমান শুল্কের সঙ্গে যোগ করা হবে নাকি প্রতিস্থাপন করা হবে।
আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত পোশাকের ওপর ১১ দশমিক ৫৬ শতাংশ শুল্ক কার্যকর আছে। তার ওপর যদি ৩৭ শতাংশ শুল্ক যোগ করা হয়, তাহলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, শুল্ক বেড়ে ৪৮ দশমিক ৫৬ শতাংশে দাঁড়াবে। অর্থাৎ ঢাকা থেকে ১০০ ডলারের টি-শার্ট বা জিন্সের চালানে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরে আমদানি শুল্ক বাবদ প্রায় ৪৯ ডলার দিতে হবে, যা বর্তমানে মাত্র ১১ দশমিক ৫৬ ডলার।
এ ব্যাপারে দেশের অন্যতম বৃহৎ ডেনিম রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এম তানভীর বলেন, আমরা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। কারণ ট্রাম্পের আদেশে পরিষ্কারভাবে এটিকে ‘অতিরিক্ত’ শুল্ক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ৯ এপ্রিলের আগে তাই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
পরিষ্কার কোনও বার্তা নেই সরকারের পক্ষ থেকেও। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমানও বলেছেন, আমরা এখনো পরিষ্কার নই। এটি ৩৭ শতাংশ হতে পারে, কিংবা যদি বর্তমান মোস্ট ফেভারড নেশন (এমএফএন) হারের সঙ্গে যোগ করা হয় তাহলে ৫২ শতাংশেরও বেশি হতে পারে, যা বাংলাদেশের জন্য ইতোমধ্যে অনেক পণ্যে ১৫ শতাংশের ওপরে আছে।
অবশ্য, নতুন শুল্কহার বিশাল হতে পারে উল্লেখ করে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির প্রশাসক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি পোশাক ব্র্যান্ড ইতোমধ্যে জানিয়েছে, বাংলাদেশে নতুন শুল্ক ৪৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ হতে পারে। সেই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই কৌশল প্রণয়ন করা হচ্ছে। আর ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশেও স্পষ্টভাবে এটাকে বাড়তি শুল্ক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মার্কিন নতুন শুল্কনীতিতে দেশের রপ্তানিকারকদের মাথাব্যথার সবচেয়ে বড় কারণ বাজার হারানোর শঙ্কা। চীনের পাশাপাশি ভিয়েতনামের পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক ধরা হলেও বাংলাদেশের চেয়ে শুল্ক কম ধরা হয়েছে ভারতের ক্ষেত্রে। ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে এখন বাংলাদেশকে টপকে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে ভারতের।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীন ও ভিয়েতনামের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। তার ঠিক একধাপ নিচে অর্থাৎ চতুর্থ স্থানে রয়েছে ভারত।
গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৭৩৪ কোটি (৭.৩৪ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ৪৬৯ কোটি (৪.৬৯ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছিল ভারত। গত বছর ভারতের রপ্তানি তার আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ বেশি হয়েছিল।
ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যে সম্পূরক শুল্ক বসিয়েছেন ২৬ শতাংশ। দেশটির পণ্যের ওপর আগে যুক্তরাষ্ট্রে আড়াই শতাংশ শুল্ক বসানো ছিল। এখন তার সঙ্গে ২৬ শতাংশ যোগ হলে সব মিলিয়ে ভারতের জন্য শুল্ক দাঁড়াবে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আগেই শুল্ক ছিল ১১ দশমিক ৫৬ থেকে ১৫ শতাংশ; তার সঙ্গে এখন ট্রাম্প যোগ করলেন ৩৭ শতাংশ। ফলে, ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য ঢোকাতে শুল্ক দিতে হবে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত। পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্যটা কত বিশাল!
শুল্কে এই দ্বিগুণ পার্থক্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরা বাংলাদেশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ভারতের দিকে চলে যাবে বলে আশঙ্কা জাগছে দেশের পোশাক ব্যবসায়ীদের মধ্যে। এর আগে চীনের পণ্যে শুল্ক বৃদ্ধির কারণে যে সুযোগ বাংলাদেশ নিয়েছিল, এখন তেমনই সুযোগ নিতে চাইবে ভারতের ব্যবসায়ীরা।
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২০২৪ সালে ৭ হাজার ৯২৬ কোটি (৭৯.২৬ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। এই বাজারে শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলো হচ্ছে চীন, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, হন্ডুরাস, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান ও দক্ষিণ কোরিয়া।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৃতীয় শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক। তবে, গত জানুয়ারির প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের ধারেকাছেও ছিল না চীন, ভিয়েতনাম, ভারতের মতো প্রতিযোগী অন্য দেশগুলো। চীনের বাজারও বাংলাদেশের দখলে আসবে বলে আশায় বুক বেঁধেছিলেন বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকরা। কিন্তু, ট্রাম্পের নতুন সিদ্ধান্তে তাদের আশার গুঁড়ে বালি পড়ল এখন।
দেশের রপ্তানিকারকদের ভাষ্য, এটা নিশ্চিত যে ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি দেশের রপ্তানি খাতের ওপর বিশাল প্রভাব ফেলবে। এখন কতটা পড়বে, তা নিয়েই আতঙ্কিত তারা।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপে দেশের রপ্তানিকারকদের পাশাপাশি সরকারেরও ভয়ের কারণ আছে। কারণ, দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সংকট উত্তরণে তাই দ্রুত কার্যকর পথ খুঁজছে সরকার। বিমসটেক সম্মেলন থেকে ফিরেই মার্কিন শুল্ক ইস্যুতে জরুরি সভার ডাক দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
শনিবার (৫ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত সেই সভা শেষে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানিয়েছেন, সংকট সমাধানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করবেন প্রধান উপদেষ্টা। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও বলেছেন, নতুন শুল্ক আরোপের বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে নেগোসিয়েশনের (সমঝোতা) উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
একাধিক সূত্র বলছে, রপ্তানি পণ্যের শুল্ক হ্রাস করার উদ্যোগের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্যাস টারবাইন, সেমিকন্ডাক্টর ও চিকিৎসাসামগ্রী আমদানিতে ৫০ শতাংশ শুল্কছাড়ের প্রস্তাব দেওয়ার চিন্তা করছে বাংলাদেশ। যেসব পণ্যে ইতিমধ্যে শুল্ক নেই, সেসব পণ্য বিনা শুল্কে আমদানি করার নীতি অব্যাহত রাখারও চিন্তাও আছে। সেইসঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ আগামী তিন মাসের জন্য এই শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার আহ্বানও জানানো হতে পারে।
আরটিভি/এসএইচএম