যানজট ও কোলাহলময় রাজধানী যখন আমাদেরকে ক্লান্ত-বিরক্ত করে তোলে, উঁচু উঁচু দালান কেড়ে নেয় শান্তিতে নিশ্বাসের নেওয়ার সুযোগ, তখন মানুষ মুক্ত পরিবেশ ও খোলা আকাশের স্বাদ গ্রহণ করতে ছুটে যায় ‘ঢাকার ফুসফুস’ হিসেবে পরিচিত রমনা পার্কে। এটি শুধুমাত্র একটি প্রাচীন উদ্যানই নয়, বরং একটি জীবন্ত উদ্ভিদ সংগ্রহশালাও।
এই পার্কে রয়েছে কনকচাঁপা, কুরসি, এসকালেট, ভাদ্রা, যাকান্ধা, নাগেশ্বর, পারিজাতসহ নানা দেশি-বিদেশি গাছ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকৃতিপ্রেমীদের নজর কেড়েছে এক বিরল প্রজাতির গাছ বাওবাব (Baobab), যার বৈজ্ঞানিক নাম Adansonia digitata।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, বাওবাব গাছ আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল, মাদাগাস্কার এবং অস্ট্রেলিয়ার নির্দিষ্ট অঞ্চলসমূহে জন্মে থাকে। এই গাছ Bombacaceae পরিবারভুক্ত এবং প্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশে জন্মায় না। তাই রমনা পার্কে এই গাছের উপস্থিতি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
এই গাছের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর গঠন। মাটি থেকে বিশাল আকারের কাণ্ড লম্বা হয়ে সোজা ওপরের দিকে উঠে গেছে। একেবারে মাথায় আবার ঝোপঝাড়ের মতো ডালপালা ছড়ানো আছে। দেখে মনে হয় ছাতার মতো।
শীতকালে বাওবাব গাছের পাতা ঝরে যায়, তখন একে অনেকটা মরা গাছের মতো দেখায়। গ্রীষ্মের শেষে আবার নতুন পাতা জন্মায়। এই গাছ উচ্চতায় প্রায় ৭৫ ফুট লম্বা হয়।
মরু অঞ্চলের গাছ বলে খুব কম পানিতেই এর প্রয়োজন মিটে যায়। এই গাছ কয়েক হাজার বছর বেঁচে থাকে। প্রথম দেখাতেই যে কারও বিস্ময় জাগায় কারণ তার মোটা কাণ্ড, অদ্ভুত গঠন এবং শুষ্ক মৌসুমে পাতা ঝরিয়ে ফেলা স্বভাব, যা একে অন্যান্য গাছ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে তোলে।
অনেকেই এই গাছকে ‘উল্টো গাছ’ (upside-down tree) বলে ডেকে থাকেন। কারণ, শীতকালে পাতাহীন কাণ্ডকে দূর থেকে শিকড়সহ উল্টো গাছের মতোই দেখায়।
ঔষধি ও পুষ্টিগুণে ভরপুর বাওবাব গাছের ফলকে সুপারফুড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, আঁশ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। এ ছাড়া ফল শুকিয়ে গুঁড়া করে তা পানীয় বা বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর খাবারেও ব্যবহার করা হয়।
পাশাপাশি গাছের পাতা ও বাকল প্রাচীন আফ্রিকান ভেষজ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এর বাইরে, এই গাছের আঁশ দিয়ে টেকসই দড়ি ও কাপড় তৈরি করা হয়।
রমনা পার্কে নিয়মিত ব্যায়াম করতে যান শাহাদাত হোসেন অনু। তিনি বলেন, প্রতিদিনই এখানে হাঁটতে আসি। গাছপালা তো অনেক দেখেছি, কিন্তু এই বাওবাব গাছ সম্পূর্ণ আলাদা।
শাহাদাত হোসেন অনু বলেন, প্রথমে বুঝতেই পারিনি এটা কী গাছ। পরে পরিচিতি সাইনবোর্ড দেখে বুঝতে পারি এটি আফ্রিকার সেই বিখ্যাত গাছ। ভাবতেই ভালো লাগছে, আমাদের ঢাকায় এমন একটা গাছ আছে। এরকম গাছ আমাদের বাচ্চাদের শেখানোর জন্যও দারুণ একটি উৎস হতে পারে।
বাওবাব গাছ আমাদের দেশে একেবারেই বিরল জানিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শাহরিয়ার আহম্মেদ বলেন, এটি শুধু চোখে দেখার জন্য নয়, গবেষণার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রজাতি। গাছটি যেমন দীর্ঘজীবী, তেমনি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
তিনি বলেন, বিশেষ করে এর কাণ্ডে পানি সংরক্ষণের ক্ষমতা এবং রাতের বেলা ফুল ফোটার পর বাদুড় দ্বারা পরাগায়ণের প্রক্রিয়া একে প্রকৃতির এক অদ্ভুত বিস্ময়ে পরিণত করেছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের এই চেয়ারম্যান বলেন, এ ধরনের বৈশ্বিক গুরুত্বসম্পন্ন প্রজাতি আমাদের উদ্ভিদবৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করে। রমনা পার্কে এই গাছটির উপস্থিতি আমাদের জন্য একটি ‘বোটানিক্যাল হেরিটেজ’ হয়ে উঠতে পারে, যদি আমরা তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও পরিচর্যা করি।
আরটিভি/আইএম