ঢাকাশনিবার, ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

যেখানে থাকা-খাওয়ায় লাগে না টাকা

সৈয়দ সাইফুল আলম শোভন

শুক্রবার, ২১ অক্টোবর ২০১৬ , ০৬:৩৫ পিএম


loading/img

পৃথিবীর যে ক’টা মেগাসিটিতে কম দামে থাকার হোটেল পাওয়া যায়, তার অন্যতম ঢাকা। এক ডলারের কিছু বেশি খরচ করলেই মিলে হোটেল। তাও আবার ভাসমান। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কল্যাণে এ সংবাদ এখন পৃথিবীর ভ্রমণপিপাসুরা জানে।

বিজ্ঞাপন

তবে টাকা ছাড়াই থাকা-খাবারের ব্যবস্থাও আছে। যেখানে নিরাপত্তা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, সহযোগিতা আর তারচেয়ে বড় কথা মানুষের বিপদে মানুষ পাশে থাকে। মানুষকে আশ্রয় দেবার এ সংস্কৃতি একটা দু’টো জায়গায় নয়। গ্রামের পর গ্রামে মিলবে এ সেবা।
 
আমার নেশা ঘুরে বেড়ানো। তাও আবার যতো কম খরচে পারা যায়। কোথাও যদি বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে তাহলে তো কথাই নেই। অবশ্য ব্যাগ, পানি আর সেলফোন নিয়ে উদ্দেশ্যহীন বেরিয়ে পড়লে বাংলাদেশে কোথাও আটকাতে হয় না। বিভিন্ন সময় ঘুরতে গিয়ে হয়েছে নতুন অভিজ্ঞতা। যুক্ত হয়েছি নতুন ভ্রমণসঙ্গীর সঙ্গে। কখনো কখনো ভ্রমণের নেশাটা হয়ে যায় আশীর্বাদ।

সর্বশেষ গন্তব্য ছিল উত্তরবঙ্গের পাবনায়। ছিল না কোনো তাড়া। তারপরও আন্তঃনগর ট্রেন দ্রুতযানে চেপে বসলাম। বরাবরের মতোই শেষ সময় টিকিট পেয়ে গেলাম। ট্রেন ছুটে চলেছে গন্তব্যের দিকে।

বিজ্ঞাপন

থাকবো কোথায়, যাবো কোথায়? এ নিয়ে কোনো প্রশ্নই করছে না আমার সঙ্গী। তবে ট্রেনে কথা বলে আমরা নিশ্চিত, যেখানে যাবো সেখানে কোনো হোটেল নেই। সবাই পরামর্শ দিল, চাটমোহর স্টেশনে রাত কাটিয়ে দিতে। অন্ধকারে ওই অঞ্চল নাকি নিরাপদ নয়।

ট্রেন রাত ১টার কিছু পর চাটমোহর পৌঁছলো। স্টেশনে নেমেও জানলাম আশেপাশে কোনো থাকার হোটেল নেই। তবে একজন ‘স্টার হোটেল’র কথা জানালো। সেটার উদ্দেশে আমরা স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়লাম। দেখি থাকার কোনো ব্যবস্থা হয় কী না। ৩০ মিনিট পথ চলার পর চাটমোহরের সেই হোটেলে এসে জানলাম এটি থাকার নয়, খাবারের।  

সেখানে ৮০ বছর বয়সী নিরাপত্তা প্রহরীর সঙ্গে পরিচয় হয়। কথা বলতে বলতে ভাবলাম চাচার সঙ্গেই রাত কাটিয়ে দেয়াটা নিরাপদ। তবে চাচা জানালেন বাস স্ট্যান্ডের মোড়ে একটা থাকার হোটেল আছে। সেলিম বোডিং। কিন্তু এতো রাতে বোডিংয়ে লোক রাখে না। আমাদের করার কিছু নেই, বোডিংয়ের মালিককে ঘুম থেকে ডেকে অনুরোধ করি থাকতে দেয়ার জন্য। ব্যবস্থাও হলো। ভাড়া ৮০ টাকা। সারারাত ছারপোকার সঙ্গে লড়াই করে ভোরে রওনা হলাম।

বিজ্ঞাপন

চারিদিকে ফসলের মাঠগুলো বিশুদ্ধ সবুজ, নদীর জলও সবুজ। নদীর নাম চিকনাই। এর পাড়ের গ্রাম আটলংকাই আমাদের গন্তব্য। যে গ্রামে গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, নদীর মিঠা পানি। সত্যিই সুখি একটা গ্রাম আটলংকা।

বিজ্ঞাপন

দূরদূরান্তের পথিকের বিশ্রাম বা সাময়িক আশ্রয়ের জন্য গ্রামের মানুষগুলো তৈরি করেছে ‘খানকা ঘর’। এক সময় প্রতিটি অবস্থাসম্পন্ন বাড়ির সামনেই একটি করে ‘খানকা ঘর’ রাখা বাধ্যতামূলক ছিল। এখনও আছে, তবে সংখ্যায় অনেক কম।

কথা হয় ওই গ্রামের রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। পেশায় শিক্ষক। জন্মের পর থেকে ‘খানকা ঘর’ দেখে আসছেন তিনি। ঝড়-তুফান বা পথিক ক্লান্ত হলে এ ঘরে আশ্রয় নেয়। সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের সেবা করেন রফিকুল ইসলামরা। এক সময় নানা কাজে ওই গ্রামে প্রচুর লোক আসতো দূরদূরান্ত থেকে। এখনো আসে, সেটা ফসল কাটা বা লাগানোর সময়।
 
‘খানকা ঘরে’ কোনো দরজা থাকে না। পৃথিবীর যে প্রান্তেরই হোন না কেন, সে ঘরে আপনার থাকার অধিকার আছে। আর আশ্রয় যখন পেয়েছেন, খাবার জোগাড় হবেই। রিজিকের মালিক আল্লাহ। ‘খানকা ঘর’র পাশেই পথিকের পানির চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা।

আমরা খাওয়া শেষ করে ঘরে বসে আছি। দুপুর বেলায় পুকুর পাড়ে শান্ত পানিতে রঙিন মাছরাঙার শিকার দেখছি। একটু দূরে চিকনাই নদীতে যাচ্ছে বাইচের নৌকা। সৌখিন মাঝিদের কণ্ঠে গান। গ্রামের মা-বৌরা করতালি দিয়ে তাদের উৎসাহ জোগাচ্ছে। বিকেলে ছেলে-বুড়ু সবাই নৌকা বাইচ দেখতে যাবে। এ উপলক্ষে নদীর পাড়ে বসেছে মেলা। এইতো আমার গ্রামবাংলা। যেখানে শুধুই মাটির গন্ধ।

মাত্র কয়েক যুগের ব্যবধানে আমার আরবান লিভিং কনসেপ্টের অন্তর্জালে জীবনকে আমি আর তুমিতে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। নাগরিক জীবনধারা যখন একটি প্রজন্মকে শেখাচ্ছে- জীবন মানে শুধুই ব্যস্ত থাকা, মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। সেখানে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিরোধে চাটমোহর থানার বিভিন্ন গ্রামের ‘খানকা ঘর’গুলো সামাজিকতা, মানবতা, মানুষের পাশে মানুষকে দাঁড়ানোর উপায় শেখানোর জীবন্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মূল্যায়ন এবং তা থেকে অর্জিত জ্ঞান যদি আমাদের নগরায়নে অন্তর্ভূক্ত করতে পারি, তাহলে আর বিচ্ছিন্ন হবো না। শেকড়হীন হয়ে পড়বে না আমাদের আগামী প্রজন্ম। শুভ কামনা আটলংকা গ্রামবাসী। আপানাদের ঐক্য, সামাজিকবন্ধন সারাদেশের জন্য উদাহরণ হোক।

এস

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন
Advertisement
Advertisement


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |