কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র অপরাধীদের ঘাঁটি, দেড় বছরে ১১ লাশ
পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্র এখন অপরাধী চক্রের নিরাপদ ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে এবং দিনে দিনে বাড়ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড।
কুয়াকাটার তৃতীয় স্তরের আবাসিক হোটেলগুলোতে নিরাপদ ঘাঁটি বানিয়ে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ওইসব অপরাধী চক্র একের পর এক অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
মাঝে মধ্যে ছিচকে অপরাধীরা র্যাব-পুলিশের জালে ধরা পড়লেও রাঘব-বোয়ালরা ঠিকই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ কারণে কুয়াকাটা পর্যটন এলাকার হোটেলসহ সৈকত এলাকায় মিলছে জ্ঞাত ও অজ্ঞাত লাশসহ মাদক কেনাবেচা, চোরাচালান ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ঘটনা। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে দু’টি আবাসিক হোটেল থেকে জোড়া লাশ উদ্ধারসহ গত দেড় বছরে কুয়াকাটার পর্যটন স্পট থেকে ১১টি লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দেখার মনোরম দৃশ্য একমাত্র সমুদ্র সৈকত সাগরকন্যা কুয়াকাটা দেখা যায়। এ কারণেই সব ঋতুতে পর্যটনপ্রেমীরা ছুটে আসে কুয়াকাটায়। পর্যটন এলাকার সুবাদে এখানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়িটা একটু শিথিল থাকে। আর এ সুযোগটি ব্যবহার করে বিভিন্ন অঞ্চলের অপরাধী চক্র এখানে অবস্থান নেয় এবং একের পর এক অপরাধ সংঘটিত করে এলাকা ত্যাগ করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সর্বশেষ গত ২৬ সেপ্টেম্বর কুয়াকাটা সৈকতের ঝাউবাগানে অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে গত ২১ সেপ্টেম্বর দু’টি আবাসিক হোটেল থেকে মো. মানিক (৪৫) ও সৌরভ জামিল সোহাগ (৪৭) নামের দুই পর্যটকের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে আবাসিক হোটেল আল্লার দান থেকে উদ্ধারকৃত মো. মানিকের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী থানার সনুয়া গ্রামে এবং সাউথ বাংলা আবাসিক হোটেল থেকে উদ্ধারকৃত সৌরভ জামিল সোহাগের বাড়ি খুলনার দৌলতপুরে।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, সৌরভ জামিল সোহাগকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী খুলনা থেকে কুয়াকাটা এনে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে যমুনা হোটেল থেকে দুই পতিতা ও চার খদ্দেরকে আটক করে পুলিশ। ৯ সেপ্টেম্বর জেলা পরিষদের কথিত লিজ নেওয়া আবাসিক হোটেল ঝিনুক ডাকবাংলো থেকে পতিতা-খদ্দের ও হোটেল ম্যানেজারসহ পাঁচজনকে আটক করে পুলিশ। গেলো চার সেপ্টেম্বর আবাসিক হোটেল পাঁচতারা থেকে বন্যপ্রাণী তক্ষকসহ এক পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১৭ আগস্ট আবাসিক হোটেল সাগরের একটি কক্ষে রাঙ্গাবালীর এক মাদরাসাছাত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ২৪ আগস্ট একই হোটেলে পটুয়াখালীর লাউকাঠি ইউনিয়নের মিঠাখালী গ্রামের এক শিশুকন্যাকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে। আবাসিক হোটেল বিশ্বাস সি প্যালেসে এক নারীর হাতে জনৈক পর্যটকের লিঙ্গ কর্তনের ঘটনাও ঘটেছে। আবাসিক হোটেল রাজু ও সাগর নীড় হোটেলে স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনায় ওই ছাত্রীর মা ২৫ আগস্ট আমতলী থানায় অপহরণ ও ধর্ষণ মামলা করে। হোটেল হলিডে ইন’এ সংখ্যালঘু এক নারীকে বিয়ের প্রলোভনে হোটেল কক্ষে নিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায় কথিত প্রেমিক। এছাড়া পায়রা আবাসিক হোটেলে বান্ধবীকে নিয়ে বেড়াতে এসে অতিরিক্ত মাদকসেবনে খুলনার এক যুবকের মৃত্যু হয়। সান ফ্লাওয়ার হোটেলে সাতক্ষীরা শ্যামনগর এলাকার পর্যটক মোবারক হোসেন লেম্বুর বনের জঙ্গলে আত্মহত্যা করে। এর আগেও লেম্বুর বনে নাম পরিচয়হীন এক পর্যটকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সিকদার রিসোর্ট অ্যান্ড ভিলাসের ছয় তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে চীনা নাগরিকের আত্মহত্যারও ঘটনা রয়েছে। কুয়াকাটা সৈকতের গঙ্গামতি রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকা থেকে এক কলেজছাত্রীর লাশ এবং গঙ্গামতির চর থেকে গর্ভবতী এক নারীর লাশ উদ্ধারের নজির রয়েছে এই পর্যটন এলাকায়। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সৈকতে ভেসে ওঠা অজ্ঞতনামা একাধিক লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। অন্যদিকে সমুদ্রে ট্রলারযোগে আসা ইয়াবার বিশাল দু’টি চালান সড়ক পথে মহিপুর ও কলাপাড়া থেকে র্যাব-৮ আটক করে। কোস্টগার্ডের অভিযানে ভারতীয় শাড়ি ও পণ্যসামগ্রী আটক করা হয়। যার একটি চালান এখনও মহিপুর থানায় জব্দের তালিকায় রয়েছে। এছাড়াও পুলিশের হাতেও একাধিকবার ইয়াবার ছোট-বড় চালান আটকের নজির রয়েছে এই কুয়াকাটায়। এমনিভাবে আবাসিক হোটেল আল-মদিনায় ঢাকার আশুলিয়ার কান্তা বিউটি পার্লারের মালিক মার্জিয়া কান্তাকে স্বামী ও তার মামাত দেবর হত্যা করে পালিয়ে যায়।
এ ব্যাপারে কুয়াকাটা ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট অ্যসোসিয়েশনের সভাপতি মো. নাসির উদ্দিন বিপ্লব বলেন, ‘কুয়াকাটায় একাধিক লাশ উদ্ধার হলেও প্রকৃতপক্ষে তা ট্রলার ডুবিসহ অন্যান্য ঘটনায় ঘটেছে। এসব ঘটনার সঙ্গে পর্যটক এলাকার কোন সম্পৃক্ততা নেই। তাই এখানে পর্যটকদের আতঙ্কিত হওয়ারও কিছু নেই’।
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এম.এ মোতালেব শরীফ বলেন, ‘কুয়াকাটার বিভিন্ন হোটেলসহ পর্যটন এলাকায় যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এগুলোর সঙ্গে স্থানীয় কোনও লোকজনের সম্পৃক্ততা নেই। হত্যাকারী বাইরে থেকে পরিকল্পিতভাবে এখানে এসে এসব ঘটনা ঘটিয়ে আবার পালিয়ে যাচ্ছে। এসব ঘটনার পর পুলিশ প্রশাসন ও আমরা হোটেল মালিকরা অনেক সতর্ক অবস্থায় রয়েছি।
কুয়াকাটায় ১৩০টি হোটেল-মোটেল রয়েছে। অথচ এর মধ্যে ৬৭টি হোটেল-মোটেলের বৈধ লাইসেন্স রয়েছে। বাকিগুলোর কোনও লাইসেন্স নেই। এর ফলে ওইসব হোটেল-মোটেলের কোনও জবাবদিহিতা না থাকায় হোটেল-মোটেলে অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে। এদেরকে লাইসেন্সের আওতায় আনতে পারলে অপরাধের সংখ্যা অনেক কমে যাবে’।
কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র আবদুল বারেক মোল্লা বলেন, ‘কুয়াকাটায় পর্যটকদের জন্য তিন স্তরের নিরাপত্তা রয়েছে। তাই এখানে খুন-গুম ও চোরাচালন নিয়ে পর্যটকদের উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। কুয়াকাটার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সুন্দর ও স্বাভাবিক রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট পুলিশের ইনচার্জ বদরুল কবির জানান, কুয়াকাটায় আগত পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ট্যুরিস্ট পুলিশ বদ্ধপরিকর এবং পর্যটকরা যাতে নির্বিঘ্নে আনন্দ উপভোগ করতে পারেন সে জন্য সর্বাত্মক কাজ করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। এছাড়া বিভিন্ন হোটেলে-মোটেলে, বীচে বা সৈকতে যেসব লাশ পাওয়া গেছে কিংবা মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যাতে কোনও অবনতি না ঘটে সে বিষয়েও নজর রাখছে ট্যুরিস্ট পুলিশ।
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কলাপাড়া সার্কেল) আহমেদ আলী জানান, এই মুহূর্তে লাশের সংখ্যা বলতে পারবো না। কুয়াকাটা পর্যটন এলাকা বিধায় বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন ধরনের মানুষ আসে। কে কি উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসে তা বলা ও বোঝা মুশকিল। তাই পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি হোটেল মালিক, স্থানীয় লোকজন ও সংবাদকর্মী সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। তাহলেই কোনও অপরাধী কর্মকাণ্ড ঘটবে না।
জেবি
মন্তব্য করুন