বন্ধুকে খুনের পর একাই জানাজা পড়েন মিজান, মরদেহের হাত ধরে ক্ষমাও চান
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় ট্রাকচালককে অপহরণের পর খুন ও গুমের রহস্য উন্মোচন করে চালকের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
শনিবার (২৪ এপ্রিল) রাত পৌনে ১২টার দিকে এ ঘটনার এক মাস পর রাঙ্গুনিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন শামীমের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে পারুয়া ইউনিয়নের একটি ডোবার মাটি খুঁড়ে মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। পরে একই দিন দুপুরে ঘটনার মূল হোতাকে সন্দ্বীপ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃত মো. নেজাম ওরফে মিজান (২৬) রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা হাজীপাড়া এলাকার নুরুল আলমের ছেলে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মিজান তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আজিজুলকে খুন ও মরদেহ গুমের ঘটনার বীভৎস বর্ণনা দিয়েছেন। মূলত পারিবারিক শত্রুতার জের ধরেই এ হত্যার পরিকল্পনা করেন মিজান। ঘটনার দিন বালু আনার নাম করে আজিজুলকে কৌশলে রাঙামাটি জেলার বেতবুনিয়া এলাকার এক নিভৃত জায়গায় নিয়ে গিয়ে ট্রাকের রেঞ্জ দিয়ে মাথায় আঘাত করে আর ছুরিকাঘাতে খুন করেন তিনি। খুনের পর একই দিন পাহাড়ে মরদেহ লুকিয়ে রাখার পর বন্ধু আজিজুলের জানাজা ও দাফনের চিন্তা আসে মিজানের মাথায়। সে অনুযায়ী গত ২৬ মার্চ রাতে তিনি মরদেহটি কাঁধে করে রাঙ্গুনিয়া থানার চৌধুরীখিলস্থ নাজিম প্রফেসরের পাহাড়ের পাদদেশে একটি ডোবার সামনে নিয়ে আসেন। সেখানে মিজান একাই মরদেহের জানাজা পড়েন। এবং কবর দেয়ার মতো করে ডোবার তলদেশে মরদেহটিকে লুকিয়ে রাখেন। এছাড়া মিজান ক্ষমা চান বন্ধুর মরদেহর হাত ধরে।
ঘটনা সূত্রে জানা যায়, গত ২৫ মার্চ রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের আল আমিন পাড়া গ্রামের আব্দুল হাকিমের ছেলে ট্রাকচালক আজিজুল হক নিখোঁজ হন। পরে ২৬ মার্চ আজিজুল হকের বাবা রাঙ্গুনিয়া থানায় একটি হারানো জিডি করলে বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে পুলিশ। গত ৬ এপ্রিল আজিজুল হকের মামা হায়দার আলী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন।
এর পরে তদন্তে আজিজের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি প্রযুক্তির সাহায্যে কক্সবাজারে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে নিশ্চিত হয় পুলিশ। ওই ঘটনার ১৫ দিন পর সূত্র ধরে কক্সবাজার সদর এলাকা থেকে মোবাইল ফোন এবং রামু এলাকা থেকে ট্রাকটি জব্দ করা হয়। অপহরণকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে ওই এলাকা থেকে ২ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তারা মিজানের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করে। তারপর পুলিশ প্রযুক্তির সাহায্যে মিজানের অবস্থান সন্দ্বীপে শনাক্ত করে। শনিবার (২৪ এপ্রিল) সন্দ্বীপ থানা পুলিশের সহায়তায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অভিযুক্ত মিজান গ্রেপ্তার হওয়ার পর হত্যার কথা স্বীকার করলেও হত্যার পদ্ধতি এবং মরদেহের অবস্থান সম্পর্কে পুলিশকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিতে থাকেন। প্রথমে তিনি দাবি করেন যে, আজিজুল সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন এবং তার মরদেহ কর্ণফুলী নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রযুক্তিগত তথ্যপ্রমাণ এবং প্রশ্নবাণের মুখে শেষ পর্যন্ত নিজে খুন করার কথা আর মরদেহের সঠিক অবস্থান জানাতে বাধ্য হন মিজান। পরে তার দেখানো মতে ডোবা থেকে আজিজুলের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, আজিজুল হককে খুন করার কথা স্বীকার করে রোববার (২৫ এপ্রিল) দুপুরে চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বেগম আঞ্জুমান আদালতে মো. নেজাম ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দেন মিজান। জবানবন্দিতে আজিজুলকে হত্যা ও গুমের ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেন। পাশাপাশি তিনি নিজ স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়ার সন্দেহ থেকেই এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছেন বলেও জবানবন্দিতে দাবি করেন।
অন্যদিকে উভয় পরিবারের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, মিজানের স্ত্রীর সঙ্গে আজিজুলের পরকীয়া প্রেম রয়েছে। মূলত এই সন্দেহ থেকেই আজিজুলকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন মিজান।
এ ঘটনার বিষয়ে রাঙ্গুনিয়া ও রাউজান সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. আনোয়ার হোসেন শামীম জানান, প্রযুক্তির সর্বোচ্চ প্রয়োগের মাধ্যমে দীর্ঘ এক মাসের নিরবচ্ছিন্ন এবং নিবিড় তদন্তে আমরা প্রায় কোনো ক্লু না থাকা এ ঘটনাটির রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছি। সেই মোতাবেক ঘটনার মূল হোতা মিজানকে গ্রেপ্তার এবং তার দেয়া তথ্যমতে ভিকটিমের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
জিএম/পি
মন্তব্য করুন