ঢাকাশনিবার, ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

যমুনার চরাঞ্চলের ৫ লক্ষাধিক মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ নৌ-যাতায়াত

সিরাজগঞ্জ সংবাদদাতা, আরটিভি নিউজ

বুধবার, ৩০ জুন ২০২১ , ০৩:৪৩ পিএম


loading/img

যমুনা নদী বেষ্টিত সিরাজগঞ্জের চরাঞ্চলে বসবাস করা প্রায় ৫ লক্ষাধিক মানুষের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌ-পথ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন নৌ-পথে চরাঞ্চলের মানুষ ছোট-বড় ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা স্পিডবোটে চেপে বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করছেন। চরাঞ্চল থেকে উৎপাদিত বা শহর থেকে প্রয়োজনীয় পণ্যও সরবরাহ হয় নৌ-পথে। নদীপথে অদক্ষ নৌকা চালকদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি, ত্রুটিপূর্ণ নৌ-যান চলাচল, ধারণ ক্ষমতার অধিক যাত্রী-পণ্য পরিবহন, লাইফ জ্যাকেট বা বয়া না থাকার ফলে ক্রমশ বাড়ছে নৌ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি। চলতি মাসেও নৌকাডুবিতে প্রাণ হারিয়েছেন দুজন। নৌ-পুলিশ বলছে সীমিত সংখ্যক যাত্রী পরিবহন, লাইফ জ্যাকেট-বয়া রাখা বাধ্যতামূলক করাসহ ত্রুটিপূর্ণ নৌযান চলাচল নিরুৎসাহিত করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিন চরাঞ্চল ঘুরে, নৌ-যান চালক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যমুনা নদী বিধৌত সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার মেছড়া ও কাওয়াখোলা, কাজিপুর উপজেলার নাটুয়ারপাড়া, চরগিরিষ, নিশ্চিন্তপুর, তেকানি, মুনসুরনগড় ও খাসরাজবাড়ি, চৌহালী উপজেলার খাস কাউলিয়া, খাসপুকুরিয়া, ঘোড়জান, ওমরপুর, বাগুটিয়া, স্থল ও সদিয়া চাদপুর এবং শাহজাদপুর উপজেলার সোনাতনি ও গালা ইউনিয়নের অবস্থান চরাঞ্চলে। এছাড়া এই চারটি উপজেলার কৈজুরি, জালালপুর, রতনকান্দি, ছোনগাছা ও সয়দাবাদ ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকা রয়েছে নদী বেষ্টিত। 

যমুনা নদীর এসব চরাঞ্চলে বসবাসকারী ৫ লক্ষাধিক মানুষের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌ-পথ। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে চরাঞ্চলের এই বিপুল মানুষ ঝুঁকি নিয়ে ছোট-বড় ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা স্পিডবোটে উঠে বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করেন প্রতিদিন। কৃষিপ্রধান চরাঞ্চলে উৎপাদিত প্রচুর পরিমাণ কৃষিজ পণ্য শহরে নেয়া বা শহর থেকে চরাঞ্চলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ হয় নৌকা যোগেই। অতীতের গুনটানা, বৈঠা বা পালতোলা নৌকার পরিবর্তে যমুনার নৌপথে চালু হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ ইঞ্জিনচালিত নৌযান। 

বিজ্ঞাপন

দ্রুতগতির স্পিডবোট বা ইঞ্জিনচালিত নৌযানে কম সময়ে একস্থান থেকে অন্যত্র যাতায়াত করছে চরাঞ্চলের মানুষ, কিন্তু বেড়েছে দুর্ঘটনার পরিমাণ। লাখো মানুষের নির্ভরতার নৌপথে বিপুল পরিমাণ ত্রুটিপূর্ণ নৌযান, অদক্ষ চালক ও নৌযান চলাচল নিয়ন্ত্রক স্থানীয় সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বেড়েছে বহুগুণে। ধারন ক্ষমতার অধিক যাত্রী পরিবহন, লাইফ জ্যাকেট বা বয়া সরবরাহ না করা, প্রখর রোদ বা প্রচণ্ড বৃষ্টি থেকে রক্ষার সুবিধা না থাকা নৌকায় যাত্রী বহন করেও অধিক ভাড়া আদায় করছে নৌযান মালিকেরা। এতে বাড়ছে নৌ-দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা। চলতি মাসে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে অন্তত ২০টি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে চৌহালীতে নৌকাডুবির ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন দুজন, নদীতে তলিয়ে গেছে অন্তত ১০ লাখ টাকার কৃষিপণ্য। তারপরও থেমে নেই চরাঞ্চলবাসী। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই নৌকা চেপে প্রয়োজনের তাগিদে ছুটছেন বিভিন্ন গন্তব্যে।

নাটুয়ারপাড়া চরের কলেজছাত্র আব্দুর রহিম আরটিভি নিউজকে বলেন, জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও নৌকায় উঠতে হয়, কারণ বিকল্প কোন পথ নেই। কিন্তু সরকার যদি নৌকা চলাচলের উপর নজরদারি বাড়াতো তাহলে অতিরিক্ত যাত্রী উঠানো, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বা যাত্রী হয়রানি বন্ধ হত। 

বিজ্ঞাপন

একই চড়ের ফজলুল হক বলেন, আমাদের চরাঞ্চলের মানুষের নৌকায় যাতায়াতের বিকল্প নেই, এর সুযোগ নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যারা ইচ্ছামত ভাড়া নির্ধারণ করে, পণ্যবাহী নৌকায় যাতায়াতে যাত্রীদের বাধ্য করে। পণ্যবাহী নৌকায় রোদ-বৃষ্টি থেকে বাচার জন্য ছই নেই, ফলে মানুষ উঠতে চায় না, এজন্য সকল নৌকার ছই খুলে রেখেছে সিন্ডিকেটের লোকজন। যেন বাধ্য হয়ে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে লম্বা পথ যেতে বাধ্য হয় যাত্রীরা। 

বিজ্ঞাপন

ঢাকায় চাকরি করা নাটুয়ারপাড়া চড়ের আফসার আলী জানান, ভয় লাগে যখন পরিবারের নারী ও শিশুদের নিয়ে নৌকা পারাপার হতে হয়। নৌকায় লাইফ জ্যাকেট বা বয়া দেয়া হয় না। অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া হয়। উত্তাল যমুনায় দুর্ঘটনা ঘটলে জীবন রক্ষা করা সম্ভব হবে না। তারপরও নারীর টানে বাড়ি ফিরলে নৌকায় ওঠা এড়ানোর উপায় নেই।

নাটুয়ারপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ আব্দুল মান্নান আরটিভি নিউজকে জানান, একসময় গুনটানা, বৈঠা বা পালতোলা নৌকায় চড়ে চর থেকে উপজেলা বা জেলা শহরে যাতায়াত করতে হতো, তাতে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগতো। এখন ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চলাচল করতে বর্ষাকালে পৌনে একঘণ্টা আর শুকনো মৌসুমে দেড় ঘণ্টা লাগে। সময় বাঁচলেও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েছে অনেক। তারপরও চরাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতে বিকল্প কোনও উপায় নেই।     

কাজিপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. খলিলুর রহমান সিরাজী বলেন, প্রয়াত নেতা মোহাম্মদ নাসিম ও প্রকৌশলী তানভীর শাকিল জয় এমপি’র অক্লান্ত পরিশ্রমে চরাঞ্চলে যে উন্নয়ন হয়েছে তা অকল্পনীয়। বিদ্যুৎ, পাকা-কাচা রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বহুতল ভবনসহ সার্বিক উন্নয়ন করা হয়েছে। কিন্তু চরাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র বাহন নৌকা। এটি পরিবর্তনের সুযোগ নেই। নৌ-বন্দর সম্পূর্ণ হলে পণ্যপরিবহন নিরাপদ হবে। 

তিনি আরও বলেন, যাত্রীসেবা নিশ্চিতে নৌকায় ছই লাগানো, কম যাত্রী উঠানোসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য উপজেলা পরিষদ থেকে নৌ-যান মালিকদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। 

সিরাজগঞ্জ সদর নৌ থানার অফিসার ইনচার্জ মো. বাবর আলী খান আরটিভি নিউজকে জানান, নৌ-দুর্ঘটনা কমাতে নৌযান চালক, মালিক ও যাত্রীদের বৈরি আবহাওয়ায় নৌপথে চলাচল না করা, লাইফ জ্যাকেট-বয়া সরবরাহ ও অধিক যাত্রী বহন না করা নিশ্চিত করতে অভিযান ও প্রচারণা চালানো হচ্ছে। নদীপথে যেকোনো দুর্ঘটনা এড়াতে নৌ-পথে নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।

এসএস
 

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন
Advertisement
Advertisement

Loading...


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |