স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও জয়পুরহাটে শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি অনেকেই। শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধারা স্বীকৃতি না পাওয়ায় একদিকে সুবিধা বঞ্চিত অবস্থায় অবহেলিত রয়েছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। অন্যদিকে একই কারণে ক্ষুব্ধ এখানকার মুক্তিযোদ্ধাসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ।
জয়পুরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আমজাদ হোসেন আরটিভি নিউজকে জানিয়েছেন, মুক্তিযদ্ধের সময় অনেকে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। পাশাপাশি অনেকে দেশে থেকেও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে প্রশিক্ষণসহ অস্ত্র চালানো শিখে সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আবার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে অনেক কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকে আজও যেমন স্বীকৃতি পাননি, আবার মুক্তিযুদ্ধে কোনো ভূমিকা না থাকলেও কিছু সুযোগ সন্ধানী কেবল তদবিরের জোরে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের সার্টিফিকেট নিয়ে অনেক সুবিধাও নিয়েছেন।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, জয়পুরহাট সদর উপজেলা, কালাই উপজেলাসহ জেলায় সুবিধা বঞ্চিত অনেক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন যারা এখনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি।
জয়পুরহাট শহরের জিরো পয়েন্টে অবস্থিত শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দানে সরকারি-বেসরকারিভাবে জাতীয়-স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে কোথাও নেই ডা. আবুল কাশেমের নাম, ছবি বা পরিচয়। ডা. কাশেম মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বুদ্ধিজীবী হওয়ায় একাত্তরে তাকে রাজাকারদের সহায়তায় হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও রাষ্ট্র তাকে স্বীকৃতি দিতে পারেনি।
১৯৭১ সালে ২৬ জুলাই সকালে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বুদ্ধিজীবী শহীদ ডা. আবুল কাশেমকে হাত-পা বেঁধে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকাররা জয়পুরহাট শহরের দেবীপুর এলাকার বাড়ি থেকে প্রথমে রেলস্টেশনে নিয়ে যায়। সেখানে গাছের সঙ্গে বেঁধে ভোর পর্যন্ত নির্যাতন করে। পরে মুখে-মাথায় কাপড় বেঁধে সদরের কুঠিবাড়ি ব্রিজ এলাকায় নিয়ে চোখ, হাতের নখ, দাঁত তুলে নির্মম নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা।
শহীদ ডা. আবুল কাশেমসহ অনেক শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কবরগুলোও রাষ্ট্রীয়ভাবে সংস্কার না করায় জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। শহীদ ডা. আবুল কাশেমের পরিবারের পক্ষে কাজী আসাদুজ্জামান জয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলেও এখনও মেলেনি তার স্বীকৃতি।
শহীদ ডা. আবুল কাশেমের মেয়ে লাইলী বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করায় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী আমার বাবাকে মেরে ফেলে। সরকারের কাছে আমার বাবার ত্যাগের স্বীকৃতি চাই।
একইভাবে সদর উপজেলার দোগাছীর ইয়াকুব আলী মণ্ডলকেও পাকিস্তানি সেনারা জিপের পেছনে বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে ভারত সীমান্তের চকবরকতের পাগলা দেওয়ান এলাকায় নিয়ে যায়। এরপর বন্দুকের বেয়নেটের খোঁচায় মৃত্যু নিশ্চিত করে এবং সেখানে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের লাশের সঙ্গে গণকবর দেয়।
শহীদ ইয়াকুব আলী মণ্ডলের নাতি আরিফুর রহমান রকেট বলেন, ১৯৭১ সালে পাকসেনারা আমার দাদাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এখনও শহীদের স্বীকৃতি পায়নি। যারা শহীদ হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক এবং মুক্তিযুদ্ধ করা লোক তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বা তালিকা নেই। তাদের সকলের তালিকা হওয়া দরকার।
শহরের খনজনপুর মিশনের সাইকেল মেকার অমর সরকার বুড়ো লোহার কামান তৈরি করে যুদ্ধে অংশ নেন। তারও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি বলে অভিযোগ পরিবারের।
মোহাম্মদ আলী আখন্দতার পরিবারের সদস্যরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন বলে জানান অমর সরকার বুড়োর ছেলে পুলন সরকার।
তিনি বলেন, আমার বাবা যুদ্ধের সময় লোহা দিয়ে কামান বানিয়ে যুদ্ধ করেছিল। সেই কামান জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু এখনও মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি পাননি। বাবার মৃত্যুর পর আমাদের পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে।
শহরের দক্ষিণ দেওয়ান পাড়ার মৃত আনজীর হোসেন চাঁদ মুক্তিযুদ্ধের সময় তার গ্রামের বাড়ি বগুড়ার বিভিন্ন অঞ্চলে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
তার পরিবারের সদস্যরা জানান, আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জয়পুরহাট জেলার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু স্বীকৃতি পাননি তিনিও। তার সন্তানরাও মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এমন অভিযোগ অনেক শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের।
মৃত আনজীর হোসেন চাঁদের ছেলে সাব্বির হোসেন বলেন, বাবার মৃত্যুর আগে শুনেছি, আমার দাদার বাড়ি বগুড়ায়। সেখানে থেকে বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। সবাই বাবাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই জানে। কিন্তু আজও তার স্বীকৃতি হয়নি। আমার মা-বাবা মৃত্যুর পর খুব কষ্টে টিনের ঘরে জীবনযাপন করছি।
কালাই উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মুনিশ চৌধুরী বলেন, জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার কাদিরপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলী আখন্দ ও একই উপজেলার বাইগুনী গ্রামের ভাষা সৈনিক মনমোহন চৌধুরী, বাখরা গ্রামের মৃত মজির হোসেন, মহেশপুর গ্রামের মৃত লুৎফর রহমান, দিঘিরাগাড়ি (প. কুজাইল) গ্রামের সাবেক সরকারি কর্মকর্তা মৃত বদিউজ্জামানসহ (পাকবাহিনীর হাতে নিহত) আরও অনেকেই একাধারে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কেউ তাদের খোঁজ খবর রাখেনি।
বঞ্চিত এসব মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠকদেরই সহকর্মী মুনিশ চৌধুরী আবেগ ভরা কণ্ঠে আরও বলেন, অনেক যোগাযোগ করেও তাদের স্বীকৃতি না পাওয়া, অবহেলা আর উদাসীনতার শিকার এসব মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের অনেকেই ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। তারা স্বাধীনতা পেলেও পাননি মর্যাদা। আর দুয়েকজন যারা বেঁচে আছেন তারাও পাচ্ছেন না স্বীকৃতি। এদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক-বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পরা তখনকার টকবগে তরুণ মোহাম্মদ আলী ও মনমোহন চৌধুরী শেষ বেলায়ও তাকিয়ে আছেন স্বীকৃতির প্রতীক্ষায়।
সংস্কৃতিকর্মী টপি মো. এনামুল হক বলেন, ছোটবেলা থেকেই শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দান দেখে আসছি। আমরা এখানে চেতনার চাষ করি। সরকারি-বেসরকারি, স্থানীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নানা কর্মসূচি হয় এ ময়দানে। শহীদ ডা. আবুল কাশেম একজন বুদ্ধিজীবী। তার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ময়দানে কিছুই নেই। তার জীবনী স্থাপনসহ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া খুবই প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করেন।
স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা জাকারিয়া হোসেন মন্টু, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহাফুজাল হক বাসুনিয়াসহ অনেকেই আক্ষেপ করে বলেন, শহীদ ডা. আবুল কাশেম, ইয়াকুব আলী মণ্ডলকে পাকবাহিনীরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। অথচ সেসবের স্বীকৃতি মেলেনি। এ ছাড়াও অনেকেই শহীদ হয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন অথচ স্বীকৃতি মেলেনি, তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
জয়পুরহাট সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আফসার আলী বলেন, অনেক শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধারা স্বীকৃতি পাননি। শহীদ ডা. আবুল কাশেম, শহীদ ইয়াকুব আলীসহ অনেকের স্বীকৃতি পাওয়ার দরকার ছিল।
জয়পুরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ আলী আরও বলেন, যারা শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ আছে, আমার অন্তরে অন্তস্থল থেকে দাবি করব এই মানুষগুলোর শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাদের মূল্যায়ন হোক।
জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক শরীফুল ইসলাম আরটিভি নিউজকে বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন বা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন তাদের অনেকেরই স্বীকৃতি মেলেনি। এমনকি অনেকে শহীদ হয়েছেন কিন্তু স্বীকৃতি পাননি।
তারা বা তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আবেদন করতে পারবেন। তদন্ত প্রতিবেদনসহ সরকারিভাবে কোনো নির্দেশনা পেলে শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের জন্য স্বীকৃতি বা রাষ্ট্রের যেকোনো সুযোগ-সুবিধার নির্দেশনা পেলেই দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে এবং এসব প্রক্রিয়া শেষে তালিকাও করা সম্ভব হবে।