দিনাজপুরের হিলিতে অভাব-অনটনের সংসারে নিজের চেষ্টায় মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে শিক্ষার্থী রিফাত ইসলাম। অদম্য মেধাবী এই শিক্ষার্থীর ইচ্ছে ছিল বলেই ঘরের চার দেয়ালে মধ্যে লেখাপড়া করে এলাকায় উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু অর্থ সংকটে সেই স্বপ্নপূরণ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ভর্তি অনিশ্চিত দুশ্চিন্তার ভাঁজ রিফাতের পরিবারে।
মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) সকালে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলা পরিষদের পাশেই মাঠপাড়া গ্রাম। সেখানে টিনের ছাউনির ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন রিফাতের বাবা-মা। দুই ভাইয়ের মধ্যে রিফাত বড়। বাবার ছোট একটি দোকানের ওপর টেনে-টুনে সংসার চলে ৪ জনের। এভাবে সেই ছোট থেকেই বেড়ে ওঠা রিফাতের।
প্রতিবেশীরা জানান, পরিবারটি অস্বচ্ছল হওয়ার কারণে রিফাতের ভালো কোনো স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। সে স্থানীয় স্কুল-কলেজে পড়ালেখা করেছে। আমরা পড়ালেখায় উৎসাহ দিয়েছি। তাকে বলতাম তুমি পড়ালেখা করো, কোনো সমস্যা হবে না। সেও আমাদের বলত এখানে থেকে পড়ালেখা করে কিছু হওয়া যায় কি না চেষ্টা করি। রিফাত আরও সাপোর্ট পেলে পড়ালেখায় আরও ভালো কিছু করতে পারত।
বাসুদেবপুর সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ারুল হক টুকু জানান, আমাদের বিদ্যালয় থেকে সে পিএসসি ও জেএসসিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল। আমরা তার পড়ালেখার প্রতি খেয়াল রাখতাম। সে ছাত্র হিসেবে মেধাবী ছিল।
হাকিমপুর সরকারি কলেজের প্রভাষক আলী ইলিয়াস হোসেন আরটিভি নিউজকে জানিয়েছেন, ২০২১ সালে রিফাত কলেজ থেকে জিপিএ-গোল্ডেন ৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করে। ক্লাসে পড়ালেখায় সে যথেষ্ট মনোযোগী ছিল। সে গভীর রাত পর্যন্ত বই নিয়ে পড়তে বসত। তার ভিতর বই ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। আমি পড়ুয়া ছাত্র হিসেবে তাকে পেয়েছি। আমি ভাবতাম সে ভালো কিছু করবে। তার মেডিকেলে চান্স পাওয়ার খবর পেয়ে আমি খুব খুশি হয়েছি।
রিফাতের সাফল্য কামনা করে সোনাপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, রিফাত মেধাবী ছাত্র। আট-দশজনের মধ্যে সে ছিল ব্যতিক্রম। তার মধ্যে একটি ইচ্ছে-শক্তি ছিল আমি পারব। আমরা তাকে সব সময় উৎসাহ জুগিয়েছি এবং তার কাছ থেকে পজিটিভ কিছু পেয়েছি। সে দেশ ও জাতির সেবা করবে এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানে অবদান রাখবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
রিফাতের বাবা আমীন ইসলাম জানান, আল্লাহ'র রহমতে সে কুমিল্লা সরকারি মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছে। শিক্ষক, প্রতিবেশী ও সকলের সহযোগিতায় সে এই পর্যন্ত আসতে পেরেছে। আমার যে আর্থিক অবস্থা, তাতে সম্ভব ছিল না। ছাত্র হিসেবেও রিফাত ভালো ছিল। আমার কোনো ব্যাংক ব্যালেন্স নাই। কষ্ট করে হলেও তাকে মেডিকেলে ভর্তি করানোর চেষ্টায় আছি। সে যেন মানুষের মত মানুষ হয় তার জন্য সকলে দোয়া করবেন।
মেডিকেলে চান্স পাওয়া শিক্ষার্থী রিফাত ইসলাম বলেন, মেডিকেলে পরীক্ষার জন্য আমার শিক্ষকেরা যথেষ্ট সাপোর্ট দিয়েছে। এমনকি আমি অন্যের কাছ থেকে বই এনে পড়েছি। আল্লাহসহ সবাই চেয়েছে বলেই আমি মেডিকেলে ৩০০ নম্বরের মধ্যে ২৭৫ দশমিক ৭৫ নম্বর পেয়ে কুমিল্লা সরকারি মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছি।
একজন চিকিৎসক হয়ে কি ধরনের সেবা করবেন এমন প্রশ্নের জবাবে রিফাত আরও বলেন, আমি গরিব পরিবারের সন্তান। আমি জানি একজন গরিব কোনো পর্যায়ে থাকে। যে কষ্ট জানবে না, সে বুঝবে না কষ্টতা কেমন। আমি যেমন কষ্ট দেখে যাচ্ছি তখন একজন মানুষের কষ্ট দেখে জানব আমিও এক সময় এমন ছিলাম, এটা একজন আমার বাবা, একজন মা, এলাকাবাসী হতে পারেন। এটা মনে করেই আমি ডাক্তারি পাস করার পর এভাবে সেবা দিতে চাই। তবে ডাক্তার হয়ে যেখানেই থাকি না কেন প্রতি মাসে আমার গ্রামে এসে মানুষের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার কথা জানান এই শিক্ষার্থী।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন উর রশিদ জানান, টাকা থাক বা না থাক ইচ্ছা-শক্তি, আগ্রহ ছিল বলেই রিফাত নিজ চেষ্টায় এই সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে। সে আমাদের গর্ব। ইতিপূর্বে তার পড়াশুনায় আগ্রহ বাড়ানোর ব্যাপারে সহযোগিতা করা হয়েছে। তার উচ্চ শিক্ষার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।