কালের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে পাল রাজাদের শাসনামলে খনন করা টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার ঐতিহ্যবাহী সাগরদিঘি। সভ্যতার সাক্ষী দিঘিটির অবস্থান উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, এলাকাটির পূর্ব নাম ছিল লোহানী। কীর্তিমান পুরুষ সাগর রাজা দিঘি খনন করার পর তার নামের সঙ্গে দিঘি যোগ করে এলাকার নামকরণ করেন সাগরদিঘি। সেই থেকে পাহাড়ি জনপদটি সাগরদিঘি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পাড়সহ দিঘির মোট আয়তন ৩৬ একর। দিঘির পাড় বেশ চওড়া হওয়ায় একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু স্থাপনা। উত্তর পাড়ে রয়েছে সাগরদিঘি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কালি মন্দির এবং দক্ষিণ পাড়ে সাগরদিঘি দাখিল মাদরাসা। পশ্চিম পাড়ে রয়েছে অস্থায়ী এলজিইডি বাংলো এবং পূর্বপাড়ে পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র।
একসময় দিঘির যৌবনের আলোকছটায় মুগ্ধ হতো প্রকৃতিপ্রেমী দর্শনার্থীরা। সবুজের সমারোহে ভরপুর ছিল দিঘির পাড়। আর সবুজ পত্রপল্লবের নান্দনিক পরিবেশ বিষণ্ন মনেও দোলা দিয়ে যেত চোখের পলকে। স্বচ্ছ পানির ঢেউ আঁচড়ে পড়ত পাড়ে। গ্রীষ্মের রোদ্দুরে অচেনা পথিকের স্নান ও তৃষ্ণা মেটাতো এর জল।
জনশ্রুতি আছে, বহুকাল আগে পাল রাজাদের শাসনামলে এ অঞ্চল ছিল ঘন বন আর জঙ্গলে ভরা। পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় বন্যপ্রাণী আর জীববৈচিত্র্য’র অভয়ারণ্য হিসাবেও পরিচিত ছিল অঞ্চলটি। এরই মাঝে গড়ে ওঠে মানুষের বসবাস। তবে এখানে পানির সংকট ছিল তীব্র। সাগর রাজা তার প্রজাদের সুপেয় পানির জন্য একটি দিঘি খননের সিদ্ধান্ত নেন। সেই অনুসারে ৩৬ একর জমির ওপর দিঘি খননের কাজ শুরু করেন। দিঘিটি খননে সময় লাগে প্রায় দুই বছর। আর এতে খননকাজে অংশ নেয় দুই হাজার শ্রমিক।
দিঘিকে ঘিরে রূপকথা আর গল্পকাহিনি থেকে জানা যায়, দিঘিটি খনন করার পর পর্যাপ্ত গভীরতা থাকা সত্ত্বেও রহস্যজনকভাবে দিঘির তলানীতে পানি না ওঠায় রাজা চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। কোনো এক রাতে রাজা স্বপ্নে আদিষ্ট হন যদি তার প্রিয়তমা স্ত্রী দিঘিতে নেমে এক কলসি পানি ঢেলে দেন তাহলে দিঘিতে পানি উঠবে। এতে রানির প্রাণসংশয়ও আছে। রাজা ঘুম থেকে জেগে সকালে রানিকে স্বপ্নের কথা সব খুলে বললেন। সব শুনে রানিও প্রজাদের সুখের কথা চিন্তা করে দিঘিতে নামার প্রয়াস ব্যক্ত করেন। দিনক্ষণ ঠিক করা হলো। রাজার বিস্ময়কর এমন সিদ্ধান্তের বাস্তব দৃশ্য নিজ চোখে দেখার জন্য নির্দিষ্ট দিনে কৌতূহলী জনতা দিঘির চারপাশে ভিড় জমায়। শুকনো দিঘিতে রানি নামলেন জলভর্তি কলসি নিয়ে। কলসি থেকে জল শুকনো দিঘিতে ঢালতেই তলদেশ থেকে পানি উঠতে শুরু করে। দেখতে দেখতে রানির সমস্ত শরীর ডুবে যেতে লাগলো পানিতে। দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রজারা হইহুল্লোড় শুরু করে দিলো। রানিকে উদ্ধারে চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না রাজার। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বাঁচানো গেল না রানিকে। প্রজাদের সুখের জন্য রানির আত্মবিসর্জনের মাধ্যমে পূর্ণতা পেল সাগর রাজার দিঘি। পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ হলো দিঘি। সাগর রাজার নামেই দিঘিটির নামকরণ হলো সাগরদিঘি। এ অঞ্চলের সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকদের বিশ্বাস এখনও রানির আত্মা রাতের আঁধারে ঘুড়ে-বেড়ায় দিঘির পাড়ে। তাই তারা রানির আত্মাকে শান্ত রাখতে বিভিন্ন সময় পূজা অর্চনা করে থাকে।
সাগর রাজা এ অঞ্চলে রেখে যাননি কোনো রাজপ্রাসাদ। তবে তার স্মৃতিবিজড়িত দিঘিটি আজ কালের গর্ভে অনেকটাই মলিন হতে চলেছে। দখল করে ভবন নির্মাণের ফলে সংকুচিত হচ্ছে দিঘির পরিধি। লিজের মাধ্যমে দিঘিটিতে করা হচ্ছে মাছ চাষ। যার ফলে দূষিত হচ্ছে পানি এবং বাতাসে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। এমন দুর্গন্ধের কারণে সাধারণ মানুষসহ দুই পাড়ের দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রশান্তির নিশ্বাস আর বিশুদ্ধ বাতাস থেকে প্রতিনিয়ত হচ্ছে বঞ্চিত। এভাবেই দিন দিন দিঘিটি তার নিজস্ব সৌন্দর্য হারাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ঐতিহ্যবাহী দিঘিটি সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছে এলাকাবাসী।
দিঘিটি এ অঞ্চলরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে তীর্থস্থান হিসাবেও বেশ জনপ্রিয়। প্রতিবছর বারুণী স্নানোৎসবে হাজারও ভক্ত বৃন্দরে আগমন ঘটে এই দিঘিকে কেন্দ্র করে।
দিঘির পারে অবস্থিত কালী মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্রী রঞ্জিত চন্দ্র বলেন, ‘এই দিঘি আমাদের কাছে পবিত্র তীর্থস্থান। পানি নষ্ট থাকায় বারুণী স্নানে অনেক সমস্যা হয়। দিঘিটির ইজারা না দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের সু-দৃষ্টি কামনা করছি।’
সাগরদিঘি ইউনিয়ন পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, দিঘিটি এ এলাকার অন্যতম নিদর্শন। এখানে প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে থেকে দর্শনার্থীরা আসেন। পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে ঘাটাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনিয়া চৌধুরী বলেন, সাগরদিঘিকে পর্যটন কেন্দ্র করার জন্য পর্যটন মন্ত্রণালয়ে আবেদনপত্র জমা দেওয়া হয়েছে এবং আবেদন মঞ্জুরও হয়েছে। পর্যায়ক্রমে কাজ হচ্ছে। তবে এর সৌন্দর্যকে ধরে রাখতে সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন হতে হবে।