ঢাকা মহানগরীর জন্য প্রণীত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধন করা বাসযোগ্য ও টেকসই ঢাকা গড়ার অন্তরায় বলে মত দিয়েছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)। তাদের দাবি অবিলম্বে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার সংশোধনের উদ্যোগ বন্ধ করার।
শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) এ নিয়ে আয়োজন করা হয় ‘ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধনের উদ্যোগ: আইপিডির পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠানের। আইপিডির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ আইপিডির পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষণগুলো তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, যে কোনো পরিকল্পনার সফলতা কিংবা ব্যর্থতা নির্ভর করে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাষ্ট্র ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সবার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আন্তরিক সদিচ্ছা, যথাযথ প্রয়োগ, প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ, আইনের শাসন ও জনস্বার্থ-জনকল্যাণ রক্ষায় পরিকল্পনা এবং নীতি-নির্দেশনার নির্মোহ ও যথাযথ বাস্তবায়নের ওপর। তার দাবি, ইতোপূর্বে প্রণীত ঢাকা মহানগরীর জন্য কাঠামোগত পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনা কিংবা ড্যাপ দলিলগুলো সঠিক ও পূর্ণ বাস্তবায়নের অভাবেই ঢাকা ক্রমান্বয়ে বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।
আদিল মুহাম্মদ আরও বলেন, ড্যাপের জনঘনত্ব জোনিং নিয়ে প্রথম থেকেই রাজউক প্রভাবশালী ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহলের পক্ষে ছাড় দিয়ে এসেছে। খসড়া ড্যাপে প্রস্তাবিত এলাকাভিত্তিক উচ্চতা জোনিং থেকে এফএআর (ফার) পদ্ধতি গ্রহণ, পরবর্তীতে এফএআরের মান বৃদ্ধি- সবক্ষেত্রেই আপসকামিতার পরিচয় দেয়া হচ্ছে। ড্যাপে বাসযোগ্য শহর গড়ে তুলতে ‘জনঘনত্ব পরিকল্পনা’ শুধু নয়, বলা হয়েছে ‘উন্নয়ন প্রাবল্য ব্যবস্থাপনা’র কথা; যে বিষয়টি পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। ইমারত নকশা ও নির্মাণ সংশ্লিষ্ট কতিপয় পেশাজীবীদের আচরণ টেকসই নির্মিত পরিবেশ ও বাসযোগ্য শহর গড়বার প্রচেষ্টার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ড্যাপের সংশোধনী ভবনের ভেতরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের অবাধ প্রবাহ ব্যাহত করে জনস্বার্থ ও জনস্বাস্থ্যকে আরও বিপর্যয়ে ফেলবে।
আইপিডির পক্ষ থেকে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, আদর্শ নগর পরিকল্পনায় ১২ ফুট সড়কের পাশে একতলা বাড়ি হতে পারে। ১৯৯৬ এর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী ১২ ফুটের পাশে তিনতলা করা যায়, যা ঢাকা শহরের জন্য ২০০৭ সাল পর্যন্ত প্রযোজ্য ছিল। অথচ এখন ড্যাপের প্রস্তাবিত সংশোধন ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, নতুন এফএআর প্রস্তাবনায় ১২ ফুট রাস্তার যদি দুইপাশে ৮ তলা ভবনের সারি সারি ইমারত তৈরি হয়, তখন যানজটসহ সেই এলাকার বাসযোগ্যতা কেমন হবে, ভবনের ভেতর আলো বাতাস কেমন প্রবেশ করবে, জনস্বাস্থ্য কেমন হবে - তা সহজেই অনুমানযোগ্য। অনুরূপভাবে ১০ লাখ জনসংখ্যার জন্য ডিজাইন করা প্লটভিত্তিক পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ড্যাপে প্রস্তাবিত এফএআর মান অনুযায়ী ২৫-৩০ লাখ লোক বসবাস করবার ফলে পূর্বাচল ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হবে- বিষয়টি নীতি নির্ধারকদের ভেবে দেখবার আহ্বান জানিয়েছে আইপিডি।
সভা থেকে ড্যাপের প্রয়োজনীয় সংশোধন এবং কার্যকর বাস্তবায়নে আইপিডির পক্ষ থেকে ৭টি প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার সংশোধনের উদ্যোগ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। ড্যাপ রিভিউ করবার ক্ষেত্রে কেবল স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহলের নয়, বরং সব অংশীজনের সুবিবেচনাপ্রসূত ও কার্যকর পরামর্শ বিবেচনায় নিতে হবে। ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি বরাবর উপস্থাপনের জন্য ওয়ার্কিং গ্রুপের সঙ্গে যথাযথ আলোচনার মাধ্যমে জনকল্যাণমুখী ও প্রয়োজনীয় সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ড্যাপের কার্যকর বাস্তবায়নের অন্তরায় ও বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও মহলকে চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ড্যাপের পরিমার্জন ও সংশোধনের উদ্যোগ শুধু ‘এফ এ আর’ এর মান বাড়ানো বা জনঘনত্ব পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট বিষয় না চিন্তা করে সামগ্রিকভাবে যে বিষয়গুলো টেকসই শহর ও জনবসতি গড়ার সঙ্গে সেই সব বিষয় নিয়েই আলোচনা ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে, স্বার্থের সংঘাত আছে এমন পরামর্শের বিষয়ে রাষ্ট্রকে যথাযথ বিবেচনা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। ড্যাপের যে কোনো নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োজনীয় সংশোধন আধুনিক নগর পরিকল্পনার ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। ড্যাপের যে কোনো ধরনের সংশোধন এ সামগ্রিক জনস্বার্থ, জনস্বাস্থ্য, শহরের বাসযোগ্যতা ও টেকসই পরিবেশকে গুরুত্ব দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন, আইপিডি পরিচালক মো আরিফুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফরহাদুর রেজাসহ অনেকে।