• ঢাকা মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৭ মাঘ ১৪৩১
logo

রেকর্ড পরিমাণ সরিষার আবাদ, মন হারিয়ে যায় দিগন্তজোড়া হলুদ সমুদ্রে

ইউসুফ দেওয়ান রাজু, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি

  ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ২১:৫০
রেকর্ড পরিমাণ সরিষার আবাদ, মন হারিয়ে যায় দিগন্তজোড়া হলুদ সমুদ্রে
ছবি : আরটিভি

মাঠের পর মাঠ হলুদে একাকার। মাঝে সরলরেখার মতো সরু মেঠোপথ। পথের দুপাশে দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত সরিষা ফুলের সারি। কুয়াশা ভেদ করে বয়ে চলা মৃদু হাওয়ায় দোল খাওয়া সরিষা মাঠকে মনে হচ্ছে, ঢেউ খেলা হলুদ সমুদ্র। আর দিগন্তজোড়া বিস্তীর্ণ সরিষা খেতের মধ্যে নিজেকে বার বার হারিয়ে যেন খুঁজে ফিরছে তরুণ-তরুণীর দল।

চলনবিলসহ সিরাজগঞ্জের ৯টি উপজেলায় এ বছর রেকর্ড পরিমাণ সরিষার আবাদ হয়েছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলার বিস্তৃত মাঠজুড়ে এখন সরিষা ফুলের হলুদের সমারোহ শোভা পাচ্ছে। চলনবিলের মধ্যে যে দিকেই তাকানো যায়, সেদিকে শুধু হলুদ আর হলুদ। ফলে মধু উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ছে। বর্তমানে সরিষার মাঠে মৌচাক ও মৌমাছি দিয়ে মধু আহরণে এখন ব্যস্ত সময় পার করছে দূর-দূরান্ত থেকে আসা মৌয়ালরা। এবার সরিষার আবাদ ভালো হওয়ায় ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় মধু আহরণও ভালো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মৌয়ালরা। এবারও ফসলের জমির পাশে পোষা মৌমাছির শত শত বাক্স নিয়ে হাজির হয়েছেন তারা। ওসব বাক্স থেকে হাজার হাজার মৌমাছি উড়ে গিয়ে মধু সংগ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছে সরিষা ফুলের মাঠে মাঠে।

সরিষা ফুলে ঘুরে বেড়ানো মধু পিয়াসী মৌমাছির গুণগুণ-গুঞ্জরণে সৃষ্ট আবহ মাতিয়ে তোলে হাজারও প্রকৃতিপ্রেমীদের। এমন আবেশে কে না হারিয়ে যেতে চায়! প্রিয় মানুষটিকে প্রকৃতির এমন আবহে প্রতিস্থাপন করে স্বপ্ন বুনতে চায় প্রেমিক মন। ছুটি কিংবা অবসর সময়ে শত শত প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ ছুটেছে এ অঞ্চলে। আর এমন সুন্দর দৃশ্য ধারণ করতে চলছে আইফোনে সেলফি তোলার প্রতিযোগিতা।


চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর ও সলঙ্গা অঞ্চলের ফসলের মাঠ এখন হলুদ রঙে মাতোয়ারা। যত দূর চোখ যায় হলুদ আর হলুদ। মাঠগুলো ছেয়ে গেছে হলুদ সরিষায়, দেখলেই মন ভরে যায়। আর হলুদ ফুলে সুশোভিত মাঠে পাখা মেলেছে মৌমাছি-ভ্রমর। তাদের গুঞ্জনে কৃষকের মনও আনন্দিত। কৃষকের আনন্দের পাশাপাশি অপার সম্ভাবনা দেখছেন মৌ খামারিরা। প্রতিবছরের মতো এবারো এ অঞ্চলের সরিষা ফুলকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মধু সংগ্রহের জন্য এসেছেন মধু চাষিরা। তারা মধু সংগ্রহের মহোৎসবে মেতে উঠেছেন। মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন মৌয়ালরা। মধু সংগ্রহের পাশাপাশি খামারিরা সরাসরি খামার থেকে মধু বিক্রিও শুরু করেছেন। সরিষা ঘিরে লাভের স্বপ্ন বুনছেন কৃষক ও মৌ খামারিরা।

সিরাজগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে ৮৬ হাজার ৪৬০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষবাদ হয়েছে। তবে বিগত বছরের তুলনায় এবার ১ হাজার ২৯০ হেক্টর জমিতে বেশি পরিমাণ সরিষা চাষ করা হয়েছে। গত বছর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৩০ হাজার ৮৬০ টন। এ বছর আবাদি জমির পরিমাণ বাড়ায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার টন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সরিষার বাম্পার ফলনের আশা করছে কৃষক ও কৃষি বিভাগ। এর পাশাপাশি সরিষা মাঠ থেকে কমপক্ষে ৩৮২ টনের বেশি পরিমাণ মধু আহরণ করা হবে। পাইকারি হিসেবে মাঠ থেকে প্রতি কেজি মধুর মূল্য ৩০০ টাকা হলে সর্বমোট এর মূল্য দাঁড়ায় ১১ কোটি টাকারও বেশি।

উল্লাপাড়ার উধুনিয়া সরিষা মাঠে মধু সংগ্রহকারী উদ্যোক্তা হারুন উর রশিদ বলেন, ‘আমাদের উপজেলায় অধিক পরিমাণ সরিষা চাষ হওয়ায় প্রতিবছর বিভিন্ন জেলার মৌ খামারিরা এখানে বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করেন। আমরা এখান থেকে মধু সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে থাকি। আমরা অনলাইনের মাধ্যমেও সরিষা ফুলের খাঁটি মধু বিক্রি করছি।’

সাতক্ষীরা থেকে চলনবিলে আসা জুমজুম মৌ খামারের স্বত্বাধিকারী বাপ্পি রহমান বলেন, ‘বিগত কয়েক বছর ধরে এ অঞ্চলে এসে মধু সংগ্রহ করি। এবারও চলনবিল এলাকায় বিস্তীর্ণ সরিষার খেতের পাশে ১০০টির বেশি মৌবাক্স বসিয়েছি। এসব বাক্স থেকে গত এক সপ্তাহ ধরে মোটামুটি ভালোই মধু পাওয়া যাচ্ছে। ঠান্ডা কমে গেলে মধু উৎপাদনের পরিমাণ আরও বাড়বে। এই মধু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা কিনে নিয়ে যান। প্রতি কেজি মধু ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা করে বিক্রি করছি।’

তাওহীদ মৌ খামারের স্বত্বাধিকারী সজিব হোসেন বলেন, ‘এবারও সরিষার আবাদ বেশি হয়েছে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবারের মধুর উৎপাদনও অনেক বাড়তে পারে। তবে মধু সঠিক বাজার ব্যবস্থা না থাকায় কয়েকটি সিন্ডিকেটের কারণে মধুর সঠিক দাম পাচ্ছি না। তাই এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন বলেন মনে করি।’

মধু সংগ্রহ করতে আসা মৌয়াল আব্দুস সামাদ বলেন, ‘এ বছর ১৮০টি মৌবাক্স স্থাপন করেছি। ইতোমধ্যে মৌবাক্সগুলো থেকে একবার ৫ মন মধু সংগ্রহ করা হয়েছে। যতদিন সরিষা ফুল থাকবে ততদিন এ এলাকায় মধু সংগ্রহ করা হবে।’

আল্লাহর দান মৌ খামারের মালিক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘সরিষার খেতে এবার গত বছরের চেয়ে বেশি মৌ বাক্স বসানো হয়েছে। এতে প্রতি সপ্তাহে ৫ থেকে ৮ মণ মধু উৎপাদন হচ্ছে। সরিষার খেতে মৌবাক্স বসানোর কারণে সরিষার ফলনও বাড়ে। খাঁটি মধু কিনতে দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই আসছে। আশা করছি, এবার অনেক লাভবান হবো।’

মধু ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মধু সংগ্রহ করতে আসে পাইকারি ব্যবসায়ীরা। ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করা উন্নতমানের মধু পাইকারি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। তবে মধু সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় কাঙ্ক্ষিত দাম পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে চলনবিল অঞ্চলে একটি মধু প্রক্রিয়াজাতকেন্দ্র করা উচিত বলে মনে করি।’

সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আ জা মু আহসান শহীদ সরকার বলেন, ‘প্রণোদনা ভালো ফলন ও সন্তোষজনক দাম পেয়ে কৃষকরা সরিষা চাষে আগ্রহী হচ্ছে। সরিষাকে কেন্দ্র মধু আহরণকারীরা সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন ফসলের মাঠে বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন। এ বছর সিরাজগঞ্জে রেকর্ড পরিমাণ সরিষার আবাদ হয়েছে। এবার ৩৮২ টন মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বছর সিরাজগঞ্জ জেলায় ৩৮২ টন মধু আহরণের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে লক্ষমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। পাইকারি দরে প্রতি কেজি মধু ৩০০ টাকা ধরলের আনুমানিক মূল্য দাঁড়ায় ১১ কোটি টাকার বেশি। এ অঞ্চলে সরিষা চাষির সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে মধু উৎপাদনও ভালো হচ্ছে। মধু আহরণ করেও ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছে।’

এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘অনেকের ধারণা মৌ মাছির কারণে সরিষার ভালো ফলন হয় না। আসলে এটি সঠিক নয় সরিষা ক্ষেতে মধু উৎপাদন যত বেশি হবে, মৌমাছির দ্বারা ফুলে ফুলে পরাগায়ন তত বেশি ঘটবে। ফলে সরিষার উৎপাদনও বাড়বে। এতে বেকার যুবকদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।’

আরটিভি/এমকে

মন্তব্য করুন

Bangal
rtv Drama
Radhuni
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
স্কুলছাত্রকে যৌন নির্যাতন: সিরাজগঞ্জের সেই বিএনপি নেতা গ্রেপ্তার
সিরাজগঞ্জে অস্ত্রসহ ২ ডাকাত গ্রেপ্তার
বকশীগঞ্জে সরিষা চাষে এবার বাম্পার ফলন
সিরাজগঞ্জে অস্ত্র মামলায় ৪ জনের যাবজ্জীবন