বাবা-মা মারা গেলেও দেখার সুযোগ ছিলো না লেন্স কর্পোরাল ফজলুর রহমানের
পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ঘটনায় বিষ্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় ১৬ বছর পর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন কুড়িগ্রামের লেন্সকর্পোরাল ফজলুর রহমান। কারাগারে থাকাকালীন মা-বাবা, বোনসহ ৯জন নিকট আত্মীয় হারিয়েছেন তিনি। এসব আত্মীয় মারা গেলেও এক নজর দেখা কিংবা জানাজায় অংশ নেয়ার সুযোগ ছিলো না তার। কারাগারে দেখা করার তেমন সুযোগ মেলেনি পরিবারের সদস্যদেরও।
এখন মুক্ত হলেও ফজলুর রহমান হয়ে পড়েছেন কিছুটা মানষিক ভারসাম্যহীন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর মুক্ত বাতাসে স্বামীকে ফিরে পেয়েও স্বামীর শাররীক অবস্থা আর চাকুরী না থাকায় অনাগত দিন নিয়ে শঙ্কায় স্ত্রী রাশেদা।
ফজলুর রহমান কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার আন্ধারীঝাড় ইউনিয়নের বারুইটারী গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। দেশ সেবার ব্রত নিয়ে যোগ দেন বাংলাদেশ রাইফেলস এ। যৌবনের দিনগুলো কেটেছে দেশের সীমান্ত রক্ষায় চৌকশ সিপাহি হিসেবে। সবেমাত্র সিপাহি থেকে লেন্সকর্পোরালপদে পদন্নতি পেয়েছেন তিনি। কর্মস্থল বিডিআর হেডকোয়ার্টার পিলখানায় থাকায় ফেঁসে যায় ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারী ঘটে যাওয়া বিডিআর হত্যাকান্ডের ঘটনায়। বিষ্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলা হয় তার নামে । প্রহসনের বিচারে ১৬ বছর কারাভোগ করে সদ্য জামিন পান তিনি।
গত ২৩ জানুয়ারী কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ২৪ জানুয়ারী বাড়িতে ফেরেন তিনি। এসময় এক হৃদয় বিদারক ঘটনা সৃষ্টি হয়। দলে দলে তাকে দেখতে আসেআত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও গ্রামবাসী। তবে ১৬ বছরে তিনি হারিয়েছেন প্রিয় মা-বাবা, বোনসহ ৯জন নিকট আত্মীয়। বিনা দোষে জেল, প্রিয়জনদের হারিয়ে মানষিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন তিনি। অনেকে তার সাথে দেখা করতে আসলে নির্বাক তাকিয়ে থাকেন তিনি। ১৬ বছর অপেক্ষার পর স্বামীকে কাছে পেয়েও নুতুন করে দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন স্ত্রী রাশেদা খাতুন। একদিকে সংসারে অভাব অনটন অন্যদিকে স্বামীর মানষিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ায় দুচোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি।
তিনি জানান, ১৬টি বছর সমাজের নানা সমালোচনা সহ্য করে খেয়ে না খেয়ে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করেছি। নিজের সন্তান না থাকায় ননদের সন্তানকে নিয়ে মানুষ করেছে। ছোট থেকেই সেই মেয়ে তার বাবাকে (ফজলুর রহমান) খুজেছে, আমি কোন উত্তর দিতে পারি নাই। এখন স্বামী ফিরে আসলেও ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। অনেককে চিনতে পারছে আবার অনেককে চিনতে পারছে না। আবোল তাবল বলছে। আমি এখন কি করবো, কোথায় যাবো।
ফজলুর রহমানের বড় ভাই ছামাদ আলী বলেন, সংসারে অভাব অনটন থাকায় ফজলুর রহমানের লেখা পড়া বন্ধ করে বিডআরে পাঠাই। সে খুব ভালো ছিলো, ছোট দুই ভাইকে তার অনুপ্রেরণায় সেনাবাহীনিতে দেই। ফজলুর রহমান দেশের জন্য কাজ করেছে। হঠাৎ কি থেকে কি হয়ে গেল বুঝতে পারিনাই। ১৬ বছর ভাই কারাগারে ছিলো আমরা তাকে দেখতে পর্যন্ত যেতে পারি নাই। মানুষ আমাদের ঘৃর্ণার চোখে দেখেছে। এই কয়েক বছরে আমাদের বাবা- মা, এক বোনসহ ৯জন নিকট আত্মীয় মারা গেছে ও দেখতে পারে নাই।
ছোট ভাই অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য ইউসুফ আলী জানান, বড় ভাই ফজলুর রহমানের অনুপ্রেণার আমরা দুই ভাই সেনাবাহীনিতে যোগ দেই। সেই পরিবারের সদস্য হয়েও আমার ভাইকে বিনা দোষে ১৬ বছর কারাভোগ করতে হলো। ১৯ তারিখের যে জাজমেন্ট ছিলো সেটাতে আমরা খুশি। আমাদের ভাইকে ফিরে পেয়েছি। তবে ভাইয়ের চাকরি নাই। এখন অসুস্থ্য। কিভাবে তার সংসার চলবে তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা আছে। সরকারের কাছে তার চাকুরী ফিরিয়ে দেয়ার দাবী জানাই।
ফজলুর রহমান বলেন,এ মামলার সাথে কোন সংশ্লিষ্ঠতা ছিলো না বলে মুক্ত হয়েছেন তিনি। ১৬ বছরে বাবা- মা, বোন মারা গেছেন,২ ফুফু মারা গেছেন, জ্যাঠা-মামাসহ আরোও কয়েকজন নিকট আত্মীয় মারা গেছেন তাদেরও দেখতে পারি নাই। তাদের তো আর ফিরে পাব না। তাদের না দেখার কষ্ট নিয়েই থাকতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমার চাকুরীটাই ছিলো একমাত্র সম্বল । এখন তো চাকুরীটাও নেই। সরকারের কাছে দাবী আমাদের পূনর্বাসন করুক। সরকার চাইলে এটা করতে পারে। পূনর্বাসন হলে আমার আর চাওয়ার কিছু নাই।
আরটিভি/এএ
মন্তব্য করুন