প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে রাতের আঁধারে কাটা হচ্ছে ফসলি জমির মাটি। সেই মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়। মাটিবাহী ভারী ট্রাকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সড়ক, ধুলায় আচ্ছন্ন পরিবেশ। এমন পরিস্থিতি ঢাকার ধামরাই উপজেলায়। ইটভাটার এমন কষাঘাতে একদিকে বিপন্ন পরিবেশ, অন্যদিকে ঝুঁকিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন। এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চান এলাকাবাসী। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান বিশেষজ্ঞদের।
উপজেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, ধামরাইয়ে অন্তত দেড় শতাধিক ইটভাটা রয়েছে। যার সিংহভাগই অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ইটভাটার কাঁচামাল কৃষি জমির টপ সয়েল। এ জন্য কৃষকদের বাধ্য করা হচ্ছে মাটি বিক্রিতে। ফসলি জমি রাতারাতি পরিণত হচ্ছে খালে। কমছে চাষের আবাদি জমি। এ জন্য গেল দুই মাসে প্রায় ৩০টির বেশি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। ভেঙে দেওয়া হয়েছে চিমনি, করা হয়েছে আর্থিক জরিমানা।
সম্প্রতি উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের ফসলি মাঠে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, রাত নেমে আসার পরপরই ভাটার নিকটবর্তী এলাকাগুলোর ফসলি জমির পাশে ভিড়তে শুরু করে বড় বড় ট্রাকের বহর। আলো নামতেই শুরু হয় মাটি কাটা। বছরের পর বছর জুড়ে বেআইনিভাবে এভাবেই ধামরাইয়ের বিভিন্ন এলাকার মাটি কেটে ইটভাটায় নেওয়া হচ্ছে। ভাটায় জমছে মাটির পাহাড়। আর প্রতিনিয়ত ছোট ছোট ডোবা-খালের অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে উপজেলাটি। এসব মাটি পরিবহনের ভারি ট্রাকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সড়ক। এতে সৃষ্ট ধুলায় আচ্ছন্ন থাকছে আশপাশের পুরো এলাকা।
ইটভাটার মাটি পরিবহনে ব্যবহার করা ভারি ট্রাকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্থানীয় সড়কগুলো। সড়কে চলাচলে ভোগান্তি পোহাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এছাড়া এতে সৃষ্ট ধুলায় আচ্ছন্ন থাকছে আশপাশের ঘরবাড়ি। এতে বাড়ছে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগ। এজন্য প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি এলাকাবাসীর।
ধামরাইয়ের বালিথা এলাকার কৃষক মো. শামসুল হক বলেন, ‘একসময় সবই আবাদি জমি ছিল। ২-৩ বার ফসল ফলাতাম। এই ভাটা কোম্পানি এসে সব জমি নষ্ট করছে। সব মাটি ইটভাটায় গেছে। সব জমি এখন খাল হয়ে গেছে। আর এমনভাবে জমির মাটি কাটে যে পাশের জমি মালিক বাধ্য হয়, কারণ অতিরিক্ত খাদ করায় পাশের জমি এমনিতেই ভেঙে পড়তে থাকে।’
মো. লাল মিয়া নামে আরেক কৃষক বলেন, ‘২-৩ ফসলি জমিগুলোর মাটি কেটে নিয়ে গেছে ইটভাটায়। ভাটায় মাটির পাহাড়, কিন্তু কৃষি জমি এখন খাল শুধু। এগুলোয় কিছু করা যায় না। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ধামরাই এক সময় খালে পরিণত হবে। এজন্য প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।’
কুশুরা এলাকার বাসিন্দা মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সড়কে বড় বড় মাটি বহনকারী, ইট বহনকারী ট্রাক চলায় চলাচলে খুব অসুবিধা হয়। মসজিদে আসতে পারি না, হাটবাজারে যাতায়াতে খুবই সমস্যা হয়। জনগণ খুব কষ্টে আছে। ঘরবাড়ি ক্ষতি হচ্ছে ধুলায়, টিন নষ্ট হচ্ছে, গাছগাছালি নষ্ট হচ্ছে। ফলন হয় না। অনেক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।’
মো. আবুল হোসেন নামে এক ভ্যান চালক বলেন, ‘ধুলার কারণে সর্দি কাশি লেগে থাকে। শাকসবজি টেকে না। রাস্তায় পানি হলে কাঁদায় ভর্তি থাকে। আবার শুকনার সময় ধুলা। জীবন একদম শেষ হয়ে গেছে। সবার বাড়িঘরে ধুলা। এই পরিণতি থেকে মুক্তি চাই।’
এদিকে ইটভাটায় কৃষি জমি কমা ও মাটি এবং ইট পরিবহনের কারণে সৃষ্ট ধুলায় প্রভাব পড়ছে পরিবেশে। শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন আশপাশের বাসিন্দারা। এছাড়া ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক ডা. আহমেদুল হক তিতাস বলেন, ‘ইটভাটার কালো ধোঁয়া স্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ। এই কালো ধোঁয়া থেকে রোগীদের শ্বাসকষ্ট হয়, নিউমোনিয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্যান্সারের ঝুঁকিও থাকে। রাস্তাঘাটে প্রচুর ধুলাবালি, এখন শ্বাসকষ্ট, ময়লা থেকে সৃষ্ট অ্যালার্জির রোগী ও যাদের আগে হাঁপানি ছিল না নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে এমন প্রচুর রোগী পাচ্ছি। এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি। আমি মনে করি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের খেয়াল রাখা দরকার যাতে কালো ধোঁয়া থেকে কারো ক্ষতি না হতে পারে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক জামাল উদ্দিন রুনু বলেন, ‘সাভার ধামরাই অঞ্চলে অনেক ইটভাটা রয়েছে। এই ইটভাটাগুলো আইনগত ভিত্তি না থাকার পরও পরিচালিত হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই পরিচালিত হয়, কারণ ইটের ব্যাপক চাহিদা আছে। ইটের বিকল্প না থাকায়, এটির চাহিদা বাজারে রয়েছে। কথা হচ্ছে, ইটের ভাটা কিভাবে পরিবেশ দূষিত করছে। প্রথমত, ইটের ভাটার চিমনি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ার সঙ্গে বাতাসে পরিবেশে কয়েকটি জিনিস ছড়াচ্ছে। সেটা কি? নক্স, নাইট্রো অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, এসপিএম অথবা পিএম ২.৫, পিএম ১০। এ কয়েকটি ছাড়াও ভলাটেল অর্গানিক মেটাল হিসেবে যেটা থাকে, ভক আর কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড তো আছেই।’
তিনি বলেন, ‘এই ইটের ভাটা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া অথবা দূষিত পদার্থসমূহ, বাতাসে মিশ্রিত হয়ে আশপাশের অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি যেমন তৈরি করছে, তেমন পরিবেশগত বিপর্যয়ও তৈরি হচ্ছে। পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিক থেকে ইকো সিস্টেমের যে গাছপালা বা প্রাণীকুল, অথবা ইনসেক্ট, যেগুলো পরাগায়ন করে, তাদের নানাভাবে বাধা প্রদান করছে। তাদের অবস্থানকে নাজুক করে দেয়। ফলে ইকো সিস্টেমের যে চেইন রয়েছে, সেটা নষ্ট হচ্ছে। আর স্বাস্থ্যগত যে ঝুঁকির কথা বলা হচ্ছে, সরাসরি ২.৫ ও পিএম ১০ ইনহেল করে মানুষ শ্বাস জনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়াও কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড অথবা নক্স সক্স এগুলো গ্রিন হাউস গ্যাস হিসেবে আমাদের শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে। ফলে মাইক্রো ক্লাইমেট যেমন পরিবর্তিত হচ্ছে, সামগ্রিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হচ্ছে। আমি মনে করি, এই ইটভাটাগুলো যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হই আইনের মধ্য দিয়ে, তাহলে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির পাশাপাশি পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটবে। এখনই উচিৎ ইটের বিকল্প পণ্য বাজারে ছাড়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা। প্রণোদনা দেওয়া ও ব্যবহারের আইনগত বাধ্যবাধকতা করা। তা না হলে আইন ও অনুশাসনকে ফাঁকি দিয়ে ইটভাটা এভাবেই চলতে থাকবে।’
কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী গেল কয়েক মাসে প্রায় অর্ধশত অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অবৈধ ইটভাটা ধ্বংস করা হচ্ছে। এ ধরনের অভিযান চালিয়ে যাওয়া হবে বলে জানায় প্রশাসন।
ধামরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মামনুন আহমেদ অনীক বলেন, ‘ধামরাইয়ে প্রতি বছর শুকনো মৌসুমে মাটি কাটার একটা হিড়িক পড়ে যায়। কারণ এখানে প্রচুর ইটভাটা রয়েছে, আর এখানকার মাটি ইট বানানোর যথোপযুক্তও। ফলে চাহিদা বেশি। এতে প্রচুর ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে। আমরা গত দুই মাসে প্রায় ৩০ টির বেশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছি। ভেকু জব্দ করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আর কৃষি জমি রক্ষায় প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতনতাও গুরুত্বপূর্ণ।’
প্রাণ প্রকৃতি রক্ষা ও ঢাকার নিকটবর্তী এলাকাটির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে ইটভাটার লাগাম টানা জরুরি। এজন্য প্রশাসন ও স্থানীয় পর্যায়ে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার দাবি সংশ্লিষ্টদের।
আরটিভি/এএএ