রাজবাড়ীতে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে এয়ার-ফ্লো মেশিন। দাম কম, পেঁয়াজ সংরক্ষণের সুবিধা, আট থেকে নয় মাস সংরক্ষণের করা যায়, ঘাটতি হয় না এবং অল্প জায়গায় রাখা যাওয়ার কারণে জনপ্রিয়তা পেয়েছে এই কৃষি যন্ত্র। কৃষি বিভাগ বলছে, চাষিরা এয়ার ফ্লো মেশিনের সাহায্যে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করলে দীর্ঘসময় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায় এবং ঘাটতি কম হয় এ জন্য পেঁয়াজের আমদানি নির্ভরতাও কমবে।
সাধারণত চাষিরা মাচা পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে থাকে। টিনের ঘরে এক থেকে দুই স্তরে বাঁশ দিয়ে মাচা বানিয়ে তার ওপর পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে। তবে এই পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করলে এক থেকে দুই মাস পরে গিয়ে পেঁয়াজে পচন শুরু হয়। কারণ, মাচায় বাতাশ প্রবেশ করতে পারে না এবং টিনের গরমে পেঁয়াজ শুকিয়ে যায় এবং পচন দেখা যায়। মাচা পদ্ধতিতে পেঁয়াজ ছয় মাস রাখলে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ পেঁয়াজ নষ্ট হয়। এ ছাড়া পেঁয়াজের রং কালো হওয়ার কারণে চাহিদাও কমে যায়। এ জন্য চাষিরা দ্রুত কম দামেই পেঁয়াজ বিক্রি করে দেয়। এর বিপরীতে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি, পাংশা ও কালুখালী উপজেলায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে এয়ার ফ্লো মেশিন।
এয়ার-ফ্লো মেশিন বসানোর জন্য পাকা ঘরে ১২ বর্গফুটের একটি হাউজ তৈরি করতে হয়। হাউজের ভেতর ১০ ইঞ্চি উঁচু করে বাঁশের মাচা তৈরি করে পাতা হয়। হাউজের মাঝখানে বসানো হয় এয়ার ফ্লো মেশিন। এরপর ১২ বর্গ ফুটের হাউজে রাখা হয়েছে তিনশ মণ পেঁয়াজ। পেঁয়াজের তাপমাত্রা ঠিক রাখার জন্য দেওয়া হয় এয়ার-ফ্লো মেশিনের সাহায্যে বাতাস।
বাতাস মেশিনের সাহায্যে নিচে গিয়ে বাঁশের মাচার নিচে ছড়িয়ে পরে এবং আস্তে আস্তে ওপরে ওঠে। ফলে পেঁয়াজের তাপমাত্রা ঠিক থাকে। এ কারণে পেঁয়াজ শুকিয়ে যায় না এবং পচন ধরে না।
রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলা শহরের অবস্থিত শাহীন মেশিনারিজ এই এয়ার-ফ্লো মেশিন তৈরি করছে। যার দাম পড়ছে ১৬ হাজার টাকা। মেশিনটি মূলত ১৬ ইঞ্চি গোলাকার ৭০ ইঞ্চি লম্বা পাইপের মধ্যে একটি ফ্যান বসানো থাকে। সেই ফ্যানের বাতাস নিচে গিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া একটি অটোসুইচ লাগানো থাকে। যার কারণে এই মোটর তিন ঘণ্টা চলে আবার তিন ঘণ্টা বন্ধ থাকে।
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি, পাংশা ও কালুখালী উপজেলার বিভিন্ন কৃষকের বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, অনেকে শোবার ঘরের একটি রুমেই হাউজ বানিয়ে তার মধ্যে এয়ার ফ্লো মেশিন বসিয়ে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করছে। অনেক কৃষক একাধিক মেশিনও বসিয়েছে।
কালুখালি উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের শ্যামসুন্দরপুর গ্রামের কৃষক মজনু বিশ্বাস বলেন, এ বছর আমি সাড়ে ৫০০ মণ পেঁয়াজ পেয়েছি। এর মধ্যে আমি ৩০০ মণ পেঁয়াজ এয়ার ফ্লো মেশিনের সাহায্যে থাকার ঘরে রেখেছি। আর বাকি পেঁয়াজ মাচা করে রেখেছি।
তিনি বলেন, এয়ার ফ্লো মেশিনের সুবিধা হলো এই হাউজে একা একাই পেঁয়াজ রাখা যায় আবার বিক্রির জন্য একা একাই নামানো যায়। বাড়তি কোনো লোকের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মাচাতে পেঁয়াজ উঠাতে গেলেও তিনজন লোকের প্রয়োজন আবার নামাতেও তিনজন প্রয়োজন। বাড়তি শ্রমিক লাগে মাচাই পেঁয়াজ রাখতে গেলে। আবার পেঁয়াজের রংও নষ্ট হয়ে যায়। শুকিয়ে যায়। সবদিক থেকে এই মেশিনের কার্যকারিতা ভালো। আগামি বছর আমি আরও একটি মেশিন বসাবো।
পাংশা উপজেলার মৌরাট ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামের কৃষক কুরবান মিঞা বলেন, আমি গত বছর পরীক্ষা করার জন্য একটি মেশিন বসিয়ে ছিলাম। ফলাফল আমি অনেক ভালো পেয়েছি। গত বছর এই হাউজের পেঁয়াজ আমি ডিসেম্বর মাসে বিক্রি করেছিলাম। কোনো পেঁয়াজ পচেনি। বিদ্যুৎ বিলও খুব একটা আসেনি। এ জন্য এবছর আমি দুটি মেশিন বসিয়ে ছয়শ মন পেঁয়াজ রেখেছি। আমি মনে করি, মাচা থেকে এভাবে পেঁয়াজ রাখার খরচ কম। কিন্তু দীর্ঘদিন রাখা যায়। এ জন্য সবারই এই পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিত।
পাংশা পৌর সভার রঘুনাথপুর এলাকার কৃষক আনিছুর রহমান বলেন, আমার নিজের কিছু পেঁয়াজ ছিল। আর কিছু পেঁয়াজ আমি কিনেছি। আমি এক হাজার মণ পেঁয়াজ রাখব। এজন্য আমি তিনটি মেশিন বসিয়েছি। যারা ব্যবহার করেছে গত বছর এমন চার থেকে পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছে, আসলেই এই মেশিনের কার্যকারিতা অনেক ভালো।
শাহীন মেশিনারিজের স্বত্বাধিকারী শাহীন মন্ডল বলেন, আমি দুই বছর আগে এই মেশিন ১০টি বানিয়ে বিক্রি করেছিলাম। গত বছর ৪০টি বিক্রি হয়েছিল। এ বছর এই মেশিন অনেক মেশিন বিক্রি হয়েছে। আমি ৩ শতাধিক মেশিন বিক্রি করেছি আমাদের রাজবাড়ী, পাংশা, বালিয়াকান্দি ও কালুখালী উপজেলার কৃষকের কাছে। এ ছাড়া পাবনা থেকেও অনেক পেঁয়াজ আমার কাছ থেকে এই মেশিন তৈরি করে নিয়ে গেছে। গত দুই বছর যারা ব্যবহার করেছে তারা কিন্তু কখনো খারাপ বলেনি। কৃষি বিভাগ এই মেশিন বিভিন্ন মেলাতে প্রদর্শন করেছে।
রাজবাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. শহিদুল ইসলাম বলেন, কয়েক বছর আগে সদর উপজেলায় এ এয়ার ফ্লো মেশিন পানি উন্নয়ন বোর্ড পরীক্ষামূলকভাবে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য চাষিদের প্রদান করে। কিন্তু তখন এটি তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। শাহীন ওইটা দেখেই বানানো শিখেছিল। এই পদ্ধতিতে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে। খুবই ভালো পদ্ধতি। আমরা চাষিদের এই পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, চাষিদের মাঝে এই এয়ার ফ্লো মেশিন বিনামূল্যে সরকারিভাবে বিতরণ করবো।
আরটিভি/এমকে-টি