গত কয়েক দিনে ময়মনসিংহ নগরীতে চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি এবং খুনের ঘটনাগুলো প্রকট আকার ধারণ করায় নগরবাসীর মধ্যে তীব্র আতঙ্ক বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ। এতে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বুধবার (১৮ জুন) সকাল ১০টায় ময়মনসিংহ নগরীর প্রাণকেন্দ্র গাঙ্গিনারপাড় এলাকার ব্যস্ততম শপিংমল অলকা নদী বাংলা কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলার মোবাইল মার্কেটে চুরির ঘটনা ঘটে। জিরোপয়েন্ট মোবাইল শপ নামের দোকানের তালা ভেঙে পাঁচ-ছয়জন অজ্ঞাতনামা যুবক দোকানে চুরির ঘটনাটি ঘটায়।
মোবাইল ফোনের দোকানের স্বত্বাধিকারী হৃদয় খান এর মতে, তার দোকানে ২৮০টির মতো মোবাইল ফোন ছিল। সকাল ১০টার দিকে দুর্বৃত্তরা তার দোকানের ভিতর প্রবেশ করে আনুমানিক ২৫০টি মোবাইল নিয়ে যায়। এছাড়াও তার ক্যাশ বাক্স ভেঙে ১০ লাখ টাকা নিয়ে যায় চোরচক্রটি। তার অভিযোগ, এতে প্রায় ১ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
এই ঘটনায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং সিআইডির বিশেষজ্ঞ টিম ঘটনাটি তদন্ত করছে। পরিদর্শনকারী পুলিশ দলের নেতৃত্ব থাকা ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, আমরা সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে যারা জড়িত তাদের শনাক্তের চেষ্টা করব। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত সময়ের ভেতর আসামি গ্রেপ্তার করতে পারব বলে আশা করছি।
এ ছাড়াও তিনি বলেন, প্রত্যেক এলাকায় ভলান্টিয়ার ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। যেখানে ৭০ লাখ নাগরিকের বসবাস সেখানে ২ হাজার পুলিশ দিয়ে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তবুও যে সকল অপরাধগুলো সংঘটিত হচ্ছে আমরা সেগুলোকে ডিটেক্ট করছি।
এর আগে, মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১টায় নগরের জিলা স্কুল মোড়ে অবস্থিত চাচার হোটেল নামক রেস্তোরার মালিককে নিজ বাড়িতে আটকে রেখে ডাকাতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় রেস্তোরাঁ মালিকের স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন কোতোয়ালি মডেল থানা একটি অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, রাত ১টার সময় অজ্ঞাতনামা দু-তিনজন ব্যক্তি সাবিনা ইয়াসমিনের স্বামী মোসা খন্দকারকে (৫০) তাদের জিলা স্কুলের মোড় সংলগ্ন বাসভবনে প্রবেশ করে হাত-পা ও মুখ বেঁধে নগদ ২৩ লাখ টাকা এবং আনুমানিক দুই লাখ টাকা মূল্যের স্বর্ণালঙ্কার চুরি করে নিয়ে গেছে।
এ ঘটনায় কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ ফিরোজ হোসেন জানান, ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করছে পুলিশের টিম। আশা করছি দ্রুতই এর রহস্য উদঘাটন করতে পারব।
তাছাড়াও গত ১৬ জুন ময়মনসিংহ নগরীর ক্লিনিক মালিক সমিতি চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যের প্রতিবাদে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। তারা অভিযোগ করেন, স্থানীয় কিছু চক্র ক্লিনিকগুলোতে নিয়মিত চাঁদা দাবি করছে এবং চাঁদা না দিলে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিচ্ছে। ক্লিনিক মালিকরা প্রশাসনের কাছে দ্রুত পদক্ষেপের দাবি জানালেও তাদের দাবী, পরিস্থিতির এখনও তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।
এদিকে মঙ্গলবার (১৭ জুন) দিনেদুপুরে নগরীর ব্যস্ততম এলাকায় এক ব্যাংক কর্মকর্তার কাছ থেকে ছিনতাইকারীরা লক্ষাধিক টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। প্রকাশ্য দিবালোকে এমন দুঃসাহসিক ছিনতাইয়ের ঘটনা নগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি নির্দেশ করে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
ভুক্তভোগী মো. মনিরুল হক (৩১) জানান, তিনি আল আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ময়মনসিংহ শাখার কর্মস্থল থেকে অটোরিকশায় করে বাসায় ফিরছিলেন। মাসকান্দা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বাইপাস এলাকায় পৌঁছামাত্র কয়েকজন যুবক তার পথরোধ করে।
ঘটনার পরপরই কোতোয়ালী মডেল থানার ৩ নম্বর ফাঁড়ির ইনচার্জ মোহাম্মদ আবুল হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল অভিযানে নামে। অভিযানে তিন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়। এ ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
আল আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ময়মনসিংহ শাখার ব্যবস্থাপক মশিউর রহমান বলেন, আমাদের সহকর্মী ছিনতাইকারীর কবলে পড়ার পাশাপাশি শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কারণে আতঙ্কিত। অফিসের সকলকে সতর্কতার সহিত চলার জন্য বলা হয়েছে।
অন্যদিকে গত (১৬ জুন) সোমবার ভোর সকালে নগরের মিন্টু কলেজ রেলক্রসিং সংলগ্ন অটোরিকশার যাত্রী এক যুবকের কাছ থেকে মোবাইল ফোন, ঘড়ি এবং মানিব্যাগ ছিনতাই করে তিন যুবক। এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নানা সমালোচনা সৃষ্টি হয়।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই ভয়াবহ অবনতির পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। প্রশাসনের দুর্বল নজরদারি, অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের অভাব, রাজনৈতিক ছত্রছায়া এবং মাদকের বিস্তার এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে বলে অনেকে মনে করছেন। অপরাধীরা যেন কোনো ধরনের ভয় ছাড়াই তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।
একের পর এক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ময়মনসিংহ নগরীর সাধারণ মানুষ চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তারা প্রশ্ন তুলছেন, দিনের পর দিন এভাবে অপরাধ চলতে থাকলে তাদের নিরাপত্তা কোথায়। নগরবাসীর দাবি, পুলিশ প্রশাসনকে এই সকল ঘটনার দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনতে হবে এবং নগরীতে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
এসব বিষয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ময়মনসিংহ মহানগরের শাখার সদস্য সচিব আল নূর মোহাম্মদ আয়াস এর মতে, শুধুমাত্র অপরাধ দমনের মাধ্যমেই নয়, বরং অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাও জরুরি। প্রশাসনের দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপই পারে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন ময়মনসিংহ মহানগর শাখার সম্পাদক আলী ইউসুফ বলেন, সম্প্রতি ময়মনসিংহ শহরে আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতির কারণে চুরি, ছিনতাই, খুন এবং অসামাজিক ঘটনা ঘটছে। জুলাই বিপ্লবের পর পুলিশের অবস্থা নড়বড়ে হওয়ায় এমন হচ্ছে। রাজনৈতিক মধ্যস্থতায় তারা নিজেদের ব্যস্ত রাখায় সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরছে না। পুলিশ নৈতিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করলে সামাজিক শৃঙ্খলা পূর্বের ন্যায় ফিরে আসবে।
আইনশৃঙ্খলার উন্নতি বা অবনতি নির্ধারণের কোনো মানদণ্ড নেই উল্লেখ করে পুলিশ সুপার কাজী আখতার উল আলম বলেন, চোর ও ছিনতাইকারীদের ধরে প্রতিনিয়ত গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেলে প্রেরণ করা হচ্ছে। গত ৩-৪ মাসে ১৩১ জন ছিনতাইকারীকে ধরা হয়েছে তারা আবার জামিনে বের হয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
আরটিভি/এএএ