• ঢাকা মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১
logo

বন্দিদশা থেকে ফিরে এসে লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিলেন নারী আইনজীবী

স্টাফ রিপোর্টার, মানিকগঞ্জ

  ০৫ নভেম্বর ২০১৯, ২১:২২
বন্দিদশা থেকে ফিরে এসে লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিলেন নারী আইনজীবী
বন্দিদশা থেকে ফিরে এসে লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিলেন নারী আইনজীবী

‘ও প্রতিদিন আমাকে মারতো। পাটা-পুঁতার পুঁতা দিয়ে আঘাত করতো, যাতে কেউ মারপিটের আওয়াজ শুনতে না পায়। আমার সারা শরীর থেঁতলে গেছে ওই আঘাতে। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আত্মহত্যা করবো। কিন্তু সেই সুযোগও পাইনি। আমি সেখান থেকে জীবিত ফিরে আসতে পারবো সে আশা ছেড়েই দিয়ে ছিলাম।

প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রতারণার মাধ্যমে বিয়ের পর লোমহর্ষক নির্যাতনের কথা জানাচ্ছিলেন মানিকগঞ্জ জেলা জজকোর্টের আইনজীবী কামরুন্নাহার সেতু।

শাওন নামে এক যুবকের কাছে ১৫ দিন বন্দিদশায় ছিলেন এ আইনজীবী।

কামরুন্নাহার সেতু বলেন, ‘প্রতারণার ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নেয়াই ওর কাজ। ও যে কত নারীর জীবন নষ্ট করেছে, কতো মানুষকে পথে বসিয়েছে- তা ও নিজেই বলতে পারবে না। ও প্রথমে নারীদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে। নানা প্রলোভনে ফেলে তাদের অন্তরঙ্গ মেলামেশার ভিডিও ধারণ করে। নিয়ে নেয় মোবাইল ফোন, আইডি কার্ড কিংবা অন্য কোনও পরিচয়পত্র। তারপর তাকে জিম্মি করে অর্থ হাতিয়ে নেয়। না দিলেই শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন।

‘এইসব অপরাধ ঢাকতে তিনি পুলিশসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে। নিজেকে অনেক বিত্তশালী ও বড় মাপের ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে খুব সহজেই মিশে যায় তাদের সঙ্গে। ব্যবহার করে প্রাইভেট কার। রাজধানীর মতিঝিলে জনি টাওয়ারে তার ফ্ল্যাট রয়েছে বলে দাবি করে’।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তার বাড়ি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার আজিমনগরে। নাম মো. শাওন মিয়া, বয়স আনুমানিক ৪০। তবে তিনি একেক সময় একেক নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে। তার ফেসবুক আইডি থেকে নেওয়া ছবি দিয়ে তার প্রকৃত পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়ে মানিকগঞ্জে আসার পর অ্যাডভোকেট কামরুন্নাহর সেতু জানান, তার বাড়ি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার জাগীর ইউনিয়নের ঢাকুলী গ্রামে। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর তিনি উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে মোরশেদকে নিয়ে তার বাবার বাড়িতে থাকেন। তিনি ২০১৩ ও ২০১৪ সালে মানিকগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে সদস্য হন। স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের সুযোগে তার সঙ্গে শাওন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে এবং বিয়ে করতে চায়। কিন্তু আচরণে সমস্যা থাকায় তিনি তাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করেন।

‘গত ৯ সেপ্টেম্বর সে আমাকে নিয়ে আমার বোনের শ্বশুরবাড়ি মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী ইউনিয়নের করচাবাঁধা গ্রামে বেড়াতে যায়। সেখানে ওই দিন অপরিচিত এক ব্যক্তিকে কাজি বানিয়ে আমার ও আমার বোনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাবিন নামায় স্বাক্ষর নেয়। এরপর সেখান থেকে আমি আমার বাবার বাড়ি ফিরে আসি। আসার পথে তিনি বলেন, এখন তুমি আমার বিয়ে করা বউ। আমার কথার বাইরে গেলে বিপদ আছে। ওকালতি বাদ দিতে হবে। আর বিয়ের কথা কাউকে বলতে নিষেধ করে। মান সম্মানের ভয়ে, আমি কাউকে কিছু বলিনি’।

‘এরপর ১৭ অক্টোবর মানিকগঞ্জ জজকোর্ট থেকে কথা আছে বলে তিনি আমাকে তার প্রাইভেটকারে উঠিয়ে সাভারের নবীনগর কহিনুর গেটের তুনু হাজীর ৬তলা বাড়ির ৪ তলার একটি কক্ষে নিয়ে যায় এবং সেখানে আমাকে স্ত্রী হিসেবে রাখে। অজানা-অচেনা জায়গায় একটি কক্ষে বন্দি থেকে আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি।’

সেখানে প্রথম দুদিন এই নারী আইনজীবীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৩য় দিন তার মানিকগঞ্জ ডাকঘরে থাকা কয়েকটি হিসাব থেকে তাকে টাকা উঠিয়ে দিতে বলে। তার কাছে অস্ত্র আছে, ভয়ে তিনি তাকে ৫ লাখ, ১০ লাখ এবং ১ লাখ করে ৩ বার উঠিয়ে দিতে বাধ্য হন। এর দুদিনপর সে তার কাছে আরও টাকা চায়। তার কাছে আর সঞ্চিত টাকা নেই জানালে সে তাকে তার নামে থাকা জমি লিখে দিতে বলে। তাকে জমি লিখে না দেওয়ায় আমার ওপর শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। আমার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয় মোবাইল ফোন, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স। তারপর বিবস্ত্র করে নগ্ন ভিডিও ধারণ করে এবং ভয় দেখিয়ে তার শেখানো কথা বলিয়ে ভিডিও রেকর্ড করে। সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। সারাদিন আমাকে ওই কক্ষে আটকে রেখে মারপিট করতে থাকে। ঘরের মধ্যে থাকা পাটার শিল দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত করে। এতে তার মুখমণ্ডলসহ বিভিন্ন অংশ থেঁতলে যায়।

সবশেষ গত ২ নভেম্বর দিবাগত রাতে আমাকে জানে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। জানে বাঁচতে আমি ওই রুমের জানালা খুলে এক প্রতিবেশীকে রাতে না ঘুমিয়ে একটু সজাগ থাকতে বলি। আমাকে বাঁচাতে আকুতি জানাই। রাত দুইটার দিকে আমাকে মারধর শুরু করে। এক পর্যায়ে জবাই করতে রান্না ঘর থেকে বটি আনতে গেলে আমি আত্মচিৎকার শুরু করি। আত্মচিৎকারে প্রতিবেশীরা ঘরের দরজায় নক করলে দরজা খুলে তিনি প্রতিবেশীদের সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। তিনি বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বাইরের লোকের কোনও কথা থাকতে পারে না। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন এবং আত্মচিৎকারে বাড়ির মালিক এসে আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে আলাদা একটি কক্ষে রাখেন।

উভয়ের পরিবারের লোক ছাড়া আমাকে দেওয়া হবে না জানালে বাড়ির মালিকসহ প্রতিবেশীকে অনুরোধ করে বলেন- তিনি নিজেই আমাকে আমার বাবার বাড়িতে দিয়ে আসবে। তার কথায় বিশ্বাস করে আমাকে তার হাতে তুলে দেয় । কিন্তু তিনি মানিকগঞ্জের দিকে না এসে ঢাকার দিকে রওয়ানা দেয়। প্রাইভেট কারে বসে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে তাদের ঢাকার ধানমন্ডি ল্যাবএইড হাসপাতালে এসে থাকতে বলে। আমাকে অস্ত্রের ভয় দেখায় এবং কথা না শুনলে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। ওই হাসপাতালে নিয়ে একজন চিকিৎসককে একটি কেবিন দিতে বলে। কেবিনে নিয়ে ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে। এটা বুঝতে পেরে আমি সেখানে থেকে চলে আসতে চাইলে আমাকে সেখানেও মারধর শুরু করে। এ ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুলিশকে খবর দিলে শাওন সেখান থেকে পালিয়ে যায়।

এসময় আমি হাইকোর্টে এক পরিচিত আইনজীবীকে ফোন দিয়ে এ ঘটনা বলে। পরে সেখান থেকে উদ্ধার করে ওই আইনজীবী আমাকে হাইকোর্টে নেয়।

তিনি আরও জানান, ঢাকার উত্তরায় তার এক পরিচিত ব্যক্তির বাসায় রোববার রাত্রিযাপন শেষে সোমবার রাতে তিনি সেখান থেকে সরাসরি মানিকগঞ্জ থানায় এসে তার ১৫ দিনের বিভীষিকাময় ঘটনার বর্ণনা দেন।

কামরুন্নাহার সেতুর বাবা সফিউদ্দিন বলেন, তার মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর ওই যুবক তার কাছে ফোন করে মেয়েকে দিয়ে ৫ লাখ টাকা চায়। না দিলে তাকে হত্যা করার হুমকি দেয়। তিনি ৩ নভেম্বর মানিকগঞ্জ থানায় ওই যুবকের বিরুদ্ধে একটি অপহরণ মামলা করেন।

মানিকগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-তদন্ত) হানিফ সরকার বলেন, ওই নারী আইনজীবীকে তার বাবার করা অপহরণ মামলায় উদ্ধার দেখিয়ে তার মৌখিক বক্তব্য রেকর্ডের জন্য তাকে মানিকগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। তিনি ইচ্ছে করলে আলাদা মামলাও করতে পারবেন বলে জানান ওই পুলিশ কর্মকর্তা।

এদিকে অভিযুক্ত মো. শাওন মিয়ার দুটি মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

এসএস

মন্তব্য করুন

rtv Drama
Radhuni
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
বেড়েই চলছে নারী নির্যাতন
যে কারণে কপালের টিপ সরিয়ে পরছেন তারা
পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৬ জনের নামে লুট ও নারী নির্যাতনের মামলা