পালানো রুখতে ১৫ বছর শিকলে বাঁধা শুক্কুর আলী
টাঙ্গাইলের মধুপুরে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে ১৫ বছর ধরে শিকল বাঁধা অবস্থায় জীবন-যাপন করছেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান শুক্কুর আলী। অথচ এটা দেখার যেন কেউ নেই। দারিদ্র্যের কষাঘাতের মধ্যে জন্ম হলেও স্বাভাবিকই ছিল শুক্কুর আলীর বেড়ে উঠা। বাবা-মায়ের চার ছেলের মধ্যে চতুর্থ শুক্কুর আলীর জন্ম ১৯৮৭ সালে। ১৪-১৫ বছর বয়স থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি। এখন গায়ে কাপড় রাখে না।
বাড়ির পাশের একটি গাছে সারাদিন শিকলে বাঁধা অবস্থায় দিন কাটে তার। সারাদিন গাছের সঙ্গে পশুর মতো বাঁধা থেকে সন্ধ্যায় ছোট একটি ঘরের খুঁটিতে আবারও শিকলে বাঁধা হয় তাকে। ঘরের মেঝের খড় চাটাইয়ের বিছানায় শুয়ার ব্যবস্থা থাকলেও প্রায়ই নিদ্রাহীন কাটে তার রাত। সকালে আবারও গাছের সঙ্গেই বাঁধা পড়ে। গত ১৫ বছর ধরে চলছে শুক্কুর আলীর এমন শিকলে বাঁধা জীবন। হতভাগ্য এই শুক্কুর আলী মধুপুর উপজেলার আলোকদিয়া ইউনিয়নের দিগরবাইদ পশ্চিম পাড়া গ্রামের দরিদ্র শাহজাহান আলী ও রহিমা দম্পতির চতুর্থ ছেলে।
গেলো সোমবার সরেজমিনে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুক্কুর সম্পর্কে নানা তথ্য। দিগরবাইদ বাজারের দোকানি শামীম জানান, দরিদ্র বাবা-মায়ের বড় আদরের ছেলে শুক্কুর কৃতিত্বের সঙ্গে প্রাথমিকের পাঠ চুকিয়ে ২০০০ সালে আলোকদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। অভাব-অনটনের সংসারের কথা চিন্তা করে কিশোর শুক্কুর লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। লেখাপাড়ায় যেমন শিক্ষকদের নজরে এসেছিল তেমনি কাজের প্রতিও ছিল আন্তরিক। দারিদ্র্যের কষাঘাতে লেখাপড়া তার আর এগোয়নি। পরিবারের অচল চাকা ঘুরাতে শেষ অবধি কাজেই মনোযোগ দেয় সে।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালের দিকে নিজেদের বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে বিক্রির দায়ে পরিজনের হাতে বেধড়ক পিটুনির শিকার হয় শুক্কুর। এতে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লাগে। তখন থেকে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে। বাড়ি থেকে কাউকে না বলে বেরিয়ে গিয়ে নিখোঁজও থেকেছে কয়েক বার। এ বিষয়ে ভালো চিকিৎসাও কখনও হয়নি তার। অনিয়মিত চিকিৎসায় অবস্থার উন্নতি ঘটেনি। তাই হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে স্বজনদের সহায়তায় বাধ্য হয়ে বাবা-মা শুক্কুরের পায়ে ২০০৫ সালে শিকল পরিয়ে পশুর মতো লালন-পালন শুরু করেন। সেই থেকে রাতে একটা ছোট ঘরে খুঁটিতে এবং সকালে বাড়ির পেছনের গাছে বেঁধে রাখা হচ্ছে। দিন দিন তার অবস্থার অবনতি ঘটছে। এখন গায়ে কোনও বস্ত্র ধারণ করে না সে। তাকে নিয়ে পরিবার বেশ বেকায়দায় রয়েছে।
শুক্কুরের ভাতিজা স্বপন মিয়া জানান, তার চাচা শুক্কুর আলী মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে বাড়ি থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। তাকে অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া যায়। মূলত হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে এখন এমনভাবে রাখা হচ্ছে।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ তালুকদার দুলাল জানান, শুক্কুর নামের এমন কোনও লোকের তথ্য তার জানা নেই। তবে সরকারি কোনও সহযোগিতার প্রয়োজন হলে ব্যবস্থা করা হবে।
মধুপুর উপজেলা সমাজসেবা অফিসার ইসমাইল হোসেন জানান, বিষয়টি আমাদের জানা নেই। কেউ জানালে প্রতিবন্ধী হিসেবে তাকে ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তবে এর চিকিৎসা বা পুনর্বাসন বিষয়ে সুযোগ থাকলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জেবি
মন্তব্য করুন