ফুরিয়ে আসছে বিদেশি ঋণের সুদে করছাড়ের মেয়াদ, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা
মাস ফুরালেই শেষ হচ্ছে বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ করছাড়ের বিশেষ সুবিধার মেয়াদ। ফলে আগামী বছর থেকে বার্ষিক প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত মাশুল গুণতে হবে বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নেওয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলোকে। এতে অবধারিতভাবেই ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে আগামীতে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
জানা যায়, ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেটে বিদেশি ঋণের সুদের ওপর ২০ শতাংশ উৎস কর আরোপ করা হয়েছিল। তবে, ব্যবসায়ী মহলের অনুরোধে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয় এ সিদ্ধান্ত।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সূত্রে জানা যায়, ডিসেম্বরের পর করছাড়ের মেয়াদ বাড়ার আর সম্ভাবনা নেই। ফলে আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে অফশোর ঋণের সুদ পরিশোধের সময় স্বাভাবিক নিয়মে ২০ শতাংশ কর আদায় করা হবে।
এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, স্বাভাবিক হারে কর আদায় করলে এ খাত থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় হবে।
তবে, উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, শিল্পায়নে বাধা সৃষ্টি করতে পারে বিশেষ সুবিধা বন্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি। বিশেষ করে, রিজার্ভের চলমান সংকটকালে কমে যেতে পারে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ।
দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান ডিবিএল গ্রুপের চারটি কোম্পানির বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০ কোটি ডলারেরও বেশি। গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ জব্বার বলেন, বর্তমানে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা বিভিন্ন কারণে ভালো নয়। এমন অবস্থায় বাড়তি কর আরোপ করা হলে আমাদের মুনাফার হার আরও কমে যাবে। এর ফলে শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান ব্যাহত হতে পারে।
তিনি বলেন, ২০ শতাংশ কর আরোপ হলে বিদেশি ঋণদাতারা তাদের নিট আয় ধরে রাখতে সুদের হার বাড়িয়ে দেবে। ফলে শেষ পর্যন্ত আমাদেরই এ অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হবে।
ব্যবসায়ীদের এমন উদ্বেগের সঙ্গে একমত ব্যাংকাররাও। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, কর বাড়ালে বিদেশি ঋণ পাওয়া আরও কঠিন হয়ে যাবে। ঋণদাতারা এ করের বোঝা ঋণগ্রহীতাদের ওপর চাপিয়ে দেবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং হ্রাস, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে আমরা আন্তর্জাতিক ঋণ আলোচনায় পিছিয়ে পড়ছি। এ অবস্থায় অতিরিক্ত কর ব্যবসার ব্যয় আরও বাড়িয়ে দেবে।
তবে, এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত সুদের আয়ের ওপর কর আরোপ করা হবে। অর্থাৎ এ কর বহন করবে বিদেশি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান।
তাদের ভাষ্যমতে, ঋণগ্রহীতারা যদি ঋণদাতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে পারেন, তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া, করছাড়ের সময় ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের ঋণদাতাদের সঙ্গে আগে থেকেই সুদের কর বিষয়ে আলোচনা করে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল এনবিআর।
উল্লেখ্য, দেশের ব্যাংকের চেয়ে বিদেশি উৎস থেকে পাওয়া অর্থায়নের সুদহার কম হয়। দেশীয় ব্যাংকের ঋণের সুদহার বর্তমানে যেখানে ১১ থেকে ১৫ শতাংশ, সেখানে বিদেশি ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (সোফর) বর্তমানে ৪ দশমিক ৬০ থেকে ৫ দশমিক ১০ শতাংশ। এর সঙ্গে ঋণদাতারা অতিরিক্ত ২ থেকে ৩ শতাংশ সুদ যোগ করেন। ফলে, বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সুদের সর্বোচ্চ হার দাঁড়ায় ৮ শতাংশ।
তবে উদ্যোক্তারা বলছেন, চাইলেই পাওয়া যায় না এই বিদেশি ঋণ। এজন্য এনভায়রনমেন্ট, সোশ্যাল অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (ইএসজি) নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় কোম্পানিগুলোকে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল বিনিয়োগকারী সমিতির সভাপতি এমএ জব্বার বলেন, এ ধরনের ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যেসব শর্ত পূরণ করতে হয়, তার খরচ ব্যবসায়ীদেরকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। বিদেশি ঋণের ওপর কর বৃদ্ধি এ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে, যার ফলে রিজার্ভ সংকটের সময় বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমে যেতে পারে।
শাশা ডেনিমস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশে কিছু কিছু ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য ঋণ পাওয়া কঠিন। আর বর্তমানে তো বেসরকারি খাত ঋণই পাচ্ছে না। এমন অবস্থায় তৈরি পোশাক, অবকাঠামো ও প্রকৌশলের মতো কিছু খাতে বিদেশি ঋণ কার্যকর সমাধান হতে পারে।
তার মতে, স্থানীয় ব্যাংকে গিয়ে যদি সহজে ঋণ পাওয়া যেত, তাহলে বিদেশি ঋণকে নিরুৎসাহিত করাটা যৌক্তিক ছিল। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এমন অবস্থায় বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিদেশি ঋণ প্রয়োজন।
ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সাবেক সভাপতি রূপালী চৌধুরী বলেন, বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে অনেক কোম্পানি বেতন ও লভ্যাংশ পরিশোধেও হিমশিম খাচ্ছে। এর মধ্যে অতিরিক্ত করের চাপ দেওয়া অযৌক্তিক।
ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সুদের ওপর এনবিআরের অতিরিক্ত কর আরোপ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী এবং বিদেশি ঋণগ্রহীতা বিএসআরএমও। গত ১১ ডিসেম্বর বিএসআরএমের মহাব্যবস্থাপক ও কোম্পানি সচিব শেখর রঞ্জন কর এনবিআরের আয়কর নীতি বিভাগে একটি চিঠি পাঠান, যেখানে তিনি লিখেন, বাংলাদেশের ব্যবসাগুলো বৈদেশিক মুদ্রার ঘন ঘন দর ওঠানামা, কাঁচামালের ক্রমবর্ধমান দাম, স্থানীয় অর্থায়নে সীমিত সুযোগ এবং এলসি নিশ্চিতকরণে বিদেশি ব্যাংকের বিলম্বসহ বিভিন্ন আর্থিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এর সঙ্গে বিদেশি ঋণের সুদের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ ব্যবসার সংকট আরও গভীর করছে। ফলে টেকসই ব্যবসা পরিচালনা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি কঠিন হয়ে পড়ছে।
এদিকে এনবিআরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিদেশি ঋণদাতাদের সঙ্গে যথাযথ আলোচনার পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) করছাড়ের সংস্কৃতি থেকে সরে আসতে চাপ দিচ্ছে। তাই বাংলাদেশের ঋণগ্রহীতাদের এমন দেশ থেকে ঋণ নেওয়া উচিত, যেসব দেশের সঙ্গে দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি রয়েছে। এ চুক্তির আওতায় ঋণগ্রহীতারা উৎস করের হার কার্যকরভাবে কমাতে পারে। পাশাপাশি ঋণদাতাদের সঙ্গেও আলোচনার সুযোগ আছে, কারণ তারা চুক্তির ভিত্তিতে উৎস করে ছাড় পেতে পারে।
আরটিভি/এসএইচএম
মন্তব্য করুন