খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। কয়েক বছর আগেই অতি বিপদে না পড়লে পাবলিক টয়লেটে যেতেন না সাধারণ মানুষ। শুধু তাই নয়, পাবলিক টয়লেটের পাশ দিয়ে গেলে নাকে রুমাল কিংবা হাত দিয়ে হাঁটতেন পথচারীরা। সুসংবাদ, কিছুদিন পর এগুলো শুধুই স্মৃতি হয়ে যাবে। রাজধানীর দু’সিটি করপোরেশনের পাবলিক টয়লেটে (গণশৌচাগার) এখন আভিজাত্য ও নান্দনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। এসবের ভেতরে প্রবেশ করলে মনে হবে, কোনো ফাইভস্টার হোটেলের ওয়াশরুম।
পাবলিক টয়লেটের শৈল্পিকতা প্রকাশ করতে গিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মেয়র আনিসুল হক বলেই ফেললেন, এতো সুন্দর টয়লেট আমার-আপনার বাড়িতে নেই। আমার মনে হয়, দেশ যারা চালান- প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতেও এতো মনোরম টয়লেট নেই।
আগে পাবলিক টয়লেটে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে প্রতিনিয়ত বিড়ম্বনার শিকার হতেন পথচারীরা। বিশেষ করে নারীরা পারলে এড়িয়ে চলতেন। বেশির ভাগ পাবলিক টয়লেটে চলতো পানি বিক্রির হিড়িক। কিন্তু সিটি করপোরেশনের প্রচেষ্টায় পরিবর্তন এসেছে পাবলিক টয়লেটগুলোতে।
খুব ভোরে বাসা থেকে বের হতে হয় লেগুনাচালক সুজনকে। মেসে পর্যাপ্ত টয়লেট না থাকায় কাজের দরকারে গোসল না করে বের হতে হয় তাকে। তাই বাধ্য হয়ে পাবলিক টয়লেটে ঢুকে ১০ টাকা দিয়ে গোসল সেরে নেন তিনি। চরম নোংরা পরিবেশেই এতোদিন তাকে পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করতে হয়েছে। তবে তাকে স্বস্তি এনে দিয়েছে এখনকার পাবলিক টয়লেট।
ভোরে রংপুর থেকে ঢাকা এসেছেন মহিদুল। কাজের দরকারে তাকে প্রায় ঢাকা আসতে হয়। দিনে দিনে ঢাকা ছাড়েন বিধায় কোনো হোটেল বা বোর্ডিংয়ে ওঠেন না।তাই সকালের গোসল ও টয়লেট ব্যবহারে পাবলিক টয়লেট-ই তার একমাত্র ভরসা। এতোদিন হাতে থাকা ব্যাগ কাউন্টারের লোকদের হাতে দিয়ে চিন্তা মাথায় নিয়ে কোনো মতে পাবলিক টয়লেট ব্যবহার ও গোসল শেষ করতেন। তবে এখন পাবলিক টয়লেটে সৌন্দর্যের পাশাপাশি লকার সুবিধা থাকায় স্বাচ্ছন্দ্যে গোসল সেরে ফেলতে পারেন বলে জানান তিনি।
পাবলিক টয়লেটের আধুনিক সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ করে এর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করলেন পথচারী তারমিন আক্তার। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকে কাজ করেন। আগে এখানে এলে নিজের মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করতো। এখন টয়লেটে ঢোকার মুখে সিসি ক্যামেরা আছে। আছেন নারী নিরাপত্তাকর্মী। মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট থাকায় সুবিধাও অনেক। আমাদের মতো যাদের ১২-১৪ ঘণ্টা ঘরের বাইরে কাজে থাকতে হয়, তাদের জন্য এমন টয়লেট এতোদিন স্বপ্নের মতো ছিল। আর এমন সুন্দর টয়লেট আমার বাসায়ও নেই।
আধুনিক পাবলিক টয়লেট ঘুরে দেখা যায়, খুবই পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা করা হচ্ছে শৌচাগারগুলো। টয়লেটে নারী, পুরুষ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে আলাদা কক্ষ, লকার, হাত ধোয়ার জায়গা এবং বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা। হাত ধোয়ার জন্য রয়েছে লিকুইড হ্যান্ডওয়াশও। পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং সিসি ক্যামেরাসহ পেশাদার পরিচ্ছন্নকর্মী ও নারী কেয়ারটেকার। ওয়াটার এইড বাংলাদেশের সহযোগিতায় এবং এইচ অ্যান্ড এম ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে টয়লেটগুলো তৈরি করছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ৫০ লাখ টাকা থেকে শুরু করে কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ করে এসব টয়লেট তৈরি করা হচ্ছে।
নগরীর পান্থকুঞ্জ, তেজগাঁও, ফার্মগেটের ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল সংলগ্ন পার্কের পাশে, মহাখালীর ওয়াসা পাম্প সংলগ্ন, শ্যামলীর শিশুপার্ক সংলগ্ন, সায়েদাবাদ, পল্টন, ওসমানী উদ্যান, বাহাদুর শাহ পার্ক, মিয়াজানগলিসহ আরো কিছু এলাকায় আধুনিক পাবলিক টয়লেট সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। অধিকাংশ টয়লেটের কাজ শেষ হয়েছে। বাকিগুলো এ বছরই শেষ হবে। নগরীতে প্রায় ২শ’র বেশি স্থানে আধুনিক পাবলিক টয়লেট তৈরি ও সংস্কারের চিন্তা করছে দু’সিটি করপোরেশনের মেয়ররা।
দেড় কোটি মানুষের বসবাসের এ শহরে প্রতিদিন প্রায় ৫৫ লাখ মানুষের পাবলিক টয়লেট ব্যবহারের চাহিদা রয়েছে। আর এ বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে স্থান, মান ও সব শ্রেণির মানুষের ব্যবহারের কথা চিন্তা করেই এসব টয়লেটের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। ৫ টাকার রশিদ গ্রহণ করে সেবা মিলবে এসব টয়লেটে। গোসলের সু-ব্যবস্থা রয়েছে। এক্ষেত্রে খরচ করতে হবে ১০ টাকা। ওয়ান টাইম গ্লাস ১ টাকা দিয়ে সংগ্রহ করলেই বিশুদ্ধ খাবার পানি পাওয়া যাবে। একজন সেবা গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে। নামাজ ও ওজুর ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে। পাশাপাশি রয়েছে লকারের ব্যবস্থা। টয়লেট ব্যবহারকালে লকার ব্যবহার করতে পারবে ব্যবহারকারী। তবে এক্ষেত্রে ৫ টাকা গুণতে হবে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল মানুষজন বিনামূল্যে এখান থেকে সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে উন্নত মানের কমোড। একসঙ্গে মোট ১০ জন সেবা গ্রহণ করতে পারবেন এখানে। সেবার মান অক্ষুণ্ন রাখার জন্য ১০ জন পরিচ্ছন্নকর্মী শিফটওয়াইজ দায়িত্ব পালন করছেন।
পাবলিক টয়লেটের বিষয়ে নগরবাসীর নেতিবাচক অভিজ্ঞতা দূর এবং পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ার জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হাতে নেয় নির্বাচনে জয়ী হবার পর।
ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক জানান, রাজধানীতে সব মিলিয়ে ২০০টি পাবলিক টয়লেটের দরকার। এখানে রয়েছে জমির সংকট। তবু আমরা চেষ্টা করছি। আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন পাবলিক টয়লেট তৈরির জন্য দরকারে জমি অধিগ্রহণ করা হবে। নগরবাসীকে পরিকল্পিত স্যানিটেশন সুবিধা উপহার দেয়ার জন্যই এ উদ্যোগ। এছাড়া নগরীতে পথচারীদের অনেক সময় যানজটের কারণে রাস্তায় থাকতে হয়। এ সময় পুরুষদের চেয়ে নারী পথচারীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন। এসব সমস্যা দূর করার জন্য নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে আরো পাবলিক টয়লেট তৈরি করা হবে।
ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন জানান, নাগরিকদের ভোগান্তি নিরসনে সিটি করপোরেশন পাবলিক টয়লেট তৈরিতে তৎপরতা বাড়িয়েছে। বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শৌচাগারের অভাবে নাগরিকদের ব্যাপক ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষ করে নারীদের কষ্ট হয় সবচেয়ে বেশি। এ সমস্যা নিরসনে করপোরেশন যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। তাই পুরনো ১৭টি পাবলিক টয়লেট সংস্কার করা হচ্ছে। ওয়াটার এইডের সহায়তায় আরো ৪৭টির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া ডিএসসিসির নিজস্ব অর্থায়নে আরো ৪০টি গণশৌচাগার তৈরির দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
এমসি/ডিএইচ