ঢালিউডের পুরোনো সমস্যা ভিডিও পাইরেসি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এবারের ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত, দর্শকপ্রিয় ‘সুড়ঙ্গ’ ছবিটি শিকার হয়েছে পাইরেসির। চলচ্চিত্র শিল্প যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, তখনই দুর্বৃত্তদের এমন হামলায় স্তব্ধ সংশ্লিষ্টরা। যদিও ইতোমধ্যে পাইরেসির সঙ্গে জড়িত দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু এতেও শঙ্কা কাটেনি নির্মাতাদের। আগামী দিনে চলচ্চিত্র শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে পাইরেসির এই ঘটনা, এমনটাই মনে করছেন নেতৃস্থানীয় প্রযোজকরা।
বছর কয়েক আগেও সিনেমা শিল্পে আতঙ্ক ছিল ভিডিও পাইরেসি। নির্মাতাদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে রেখেছিল ভিডিও দস্যুরা। ব্ল্যাকমেল করে ছবি প্রযোজকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করত এরা।
সিনেমা ব্যবসায় মন্দা নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে এদের দৌরাত্মও কমে যায়। অনেক দিন ভিডিও পাইরেসির কথা শোনা যায়নি ফিল্মপাড়ায়।
এবারের ঈদে দর্শকরা সিনেমা হলে ফিরতেই পুরোনো ভয়ংকর চেহারায় দেখা দিয়েছে ভিডিও দস্যুরা। ঈদের ছবিগুলো যখন দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছিল সিনেমা হলে, তখনই পাইরেসির আতঙ্ক জাগানিয়া খবর।
ঈদের মাসখানেক না যেতেই রায়হান রাফী পরিচালিত, আফরান নিশো ও তমা মির্জা অভিনীত সুপারহিট ছবি ‘সুড়ঙ্গ’র প্রিন্ট ঘুরতে থাকে অনলাইনে। ইউটিউব ও ফেসবুকে বহুল আলোচিত ছবিটির পাইরেটেড কপি দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে লোকজন। একে-অন্যের সঙ্গে শেয়ারের মধ্য দিয়ে দ্রুত সময়ে ‘সুড়ঙ্গ’র কপি ছড়িয়ে পড়ে অনলাইনের সর্বত্র।
ক্ষতি মহামারি আকার ধারণ করার আগেই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে অভিযোগ জানায় ‘সুড়ঙ্গ’র প্রযোজনা সংস্থা আলফা আই ও চরকি। ‘সুড়ঙ্গ’ টিম ডিএমপির ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের সঙ্গে দেখা করে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে।
এর পরপরই গ্রেপ্তার হয় ‘সুড়ঙ্গ’ পাইরেসির সঙ্গে জড়িত দুজন দুষ্কৃতিকারী। এই দুই পাইরেট ধরা পড়ায় সিনেমাপাড়ায় নেমে আসে স্বস্তি। তবে এই স্বস্তি সাময়িক। পাইরেসি আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোয় আতঙ্কিত চলচ্চিত্র প্রযোজকরা। তারা বলছেন, পাইরেসি দূর করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মিলে অনেক কাজ করেছে চলচ্চিত্র সংগঠনগুলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্মূল করা যায়নি সিনেমার এই অভিশাপকে।
প্রযোজক নেতা খোরশেদ আলম খসরু বলেন, আমরা একসময় ৪০০ থেকে ৪৫০টি পাইরেসির মামলা করেছি প্রযোজক সমিতি থেকে। সেই সময় অনেক দমে ছিল পাইরেসি। ডিজিটাল ভার্সনে পাইরেসির রোধ করার কোনো উপায় আমরা দেখছি না। প্রশাসনের লোক অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে। তারা বলে, কোথা থেকে হচ্ছে, আমরা তো জানি না। কীভাবে বের করব, আমরা এর কোনো ক্লু পাই না, হদিস পাই না। প্রশাসন যদি এই কথা বলে, আমরা কোথায় যাব? আমি তো মনে করি, এটা বাংলা চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে একটা বিরাট ষড়যন্ত্র। প্রশাসন কেন এটা পারে না, আমি বুঝি না। আমার ‘গলুই’ পাইরেসি হয়েছে, আমরা গিয়েছি প্রশাসনের কাছে। তারা কোনো সমাধান দিতে পারেনি। আমরা পারিনি ‘গলুই’-কে বাঁচাতে।
এদিকে পাইরেসি ঠেকানো নিয়েও অন্য সবকিছুর মতো বিভক্ত সিনেমা সংশ্লিষ্টরা। চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা জাজ মাল্টিমিডিয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি করেছে, তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে ছবি রিলিজ হলে পাইরেসি হয় না। কিন্তু প্রযোজকরা বলছেন, এই দাবির সত্যতা নেই।
প্রযোজক মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, ‘পাসওয়ার্ড’ সিনেমা আমি জাজ মাল্টিমিডিয়া থেকে রিলিজ করেছি। সেখানে আমার ছবিটা পাইরেসি হয়েছে এক সপ্তাহ পর। আমি অভিযোগ দিয়েছি প্রযোজক সমিতিতে। সেই অভিযোগটা যাচাই-বাছাই হয়েছে। তাদেরকে ডাকানোও হয়েছে। এবং তারা সঠিক উত্তরও দিতে পারেনি। আসলাম ভাই নামের একজন প্রযোজক আছেন, ওনার ছবি রিলিজের আগেই জাজ থেকে পাইরেসি হয়ে গেছে। উনিও একই অভিযোগ করেছেন জাজ মাল্টিমিডিয়ার বিরুদ্ধে।
প্রযোজক ও পরিচালক অনন্য মামুন এক ফেসবুক পোস্টে অভিযোগ করেছেন, জাজ মাল্টিমিডিয়া অন্যান্য প্রযোজনা সংস্থাকে মাঠ থেকে বিতাড়িত করতেই মিথ্য তথ্য ছড়াচ্ছে।
বর্ষীয়ান প্রযোজক ও প্রদর্শক মির্জা আব্দুল খালেক মনে করেন, পাইরেসি রোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে বলিউডও, কোনো প্রযুক্তিই পাইরেসি ঠেকাতে যথেষ্ট নয়।
মির্জা আব্দুল খালেক বলেন, ‘সুড়ঙ্গ’ রিলিজ হয়েছে ভারতের সেরা সেরা সার্ভার থেকে। ‘প্রিয়তমা’ রিলিজ হয়েছে জাজ মাল্টিমিডিয়ার সার্ভারে। কোনো পাইরেসি সার্ভারের মাধ্যমে হয়নি। পাইরেসিটা হয়েছে, আমি যেটা দেখলাম, পর্দা থেকে ভালো ক্যামেরা দিয়ে তোলা হয়েছে। জাজের সার্ভার থেকে যেমন পাইরেসি হওয়ার সুযোগ নাই, ভারতীয় যে সার্ভার এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আছে—সেটা থেকেও পাইরেসি হওয়ার সুযোগ নাই। পর্দা থেকে ছবি তুলে কেউ যদি করে, আপনি কীভাবে ঠেকাবেন? বোম্বের ছবি কি পাইরেসি হচ্ছে না? বাংলাদেশে আমরা বোম্বের ছবি ৭ দিন পরই দেখছি, হলিউডের ছবিও তিন দিন পরেই দেখছি। এটা হচ্ছে এবং হবে। আমার মনে হয় না, এটাকে ঠেকানোর কোনো উপায় আছে।
একদিকে সিনেমা হলের আঙিনায় ফিরছে দর্শক, অন্যদিকে তাদেরকে ঘরে বসেই সিনেমা হলের স্বাদ দিতে তৎপর ভিডিও দস্যুরা। এরমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে সর্ষের ভেতর ভূতের অস্তিত্ব নিয়ে। প্রদর্শক নাকি পরিবেশক, কোন দলের প্ররোচনা থাকছে পাইরেসিতে, তা নিয়েও আছে প্রশ্ন। তবে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের মুখোশ উন্মোচনের দাবি করেছেন সাধারণ চলচ্চিত্রকর্মীরা।