• ঢাকা মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১
logo

সাক্ষাৎকারে টি ডব্লিউ সৈনিক

‘ভালো গীতিকবিতা খুঁজে পাইনি বলে কাজের সংখ্যা কম’

  ২৯ মে ২০২৪, ১৭:২০
ছবি : টি ডব্লিউ সৈনিকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

‘তুমি আমার ঘুম’ গানটি শোনেননি এমন শ্রোতার সংখ্যা খুবই কম। অনেকেই আবার খোঁজেন এই শিল্পীর নতুন গান। সম্প্রতি কাজসহ নানা বিষয় নিয়ে টি ডব্লিউ সৈনিক মুখোমুখি হয়েছিলেন আরটিভি অনলাইনের

আরটিভি: ‘তুমি আমার ঘুম’ গান তৈরির পেছনের গল্পটা কেমন ছিল?
টি ডব্লিউ সৈনিক: ১৯৯৯-২০০০ সালের ঘটনা। তখন আমি ‘বেনসন অ্যান্ড হ্যাজেজ স্টার সার্চ’ প্রতিযোগিতায় ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করি। সেখানে পরিচয় হয় আইয়ুব বাচ্চু ভাই, লাবু ভাই, ফুয়াদ নাসের বাবু ভাইসহ আরও অনেকের সাথে। কাজের ফাঁকে প্রায়ই গান করা হতো। তারাও খুব পছন্দ করতেন। পরে ২০০৩ সালে একদিন প্রতিযোগিতা চলাকালীন সময়ে বাচ্চু ভাই ও লাবু ভাই আমাকে ডাকেন এবং কঠোরভাবে বলেন, সামনের বছর তোকে আমরা স্টেজে দেখতে চাই। ক্যামেরার পেছনে দেখতে চাই না। তুই সামনের বছরে প্রতিযোগিতায় নাম লেখাবি, গান গাইবি। নাহলে তোর ঠ্যাং ভেঙে দেবো। তাদের এমন কথায় অবাক হলাম, খুশি হলাম। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম আমিও গাইবো। তাছাড়া আমার তো ছায়ানট থেকে তালিমও নেওয়া আছে। অন্যরা পারলে আমি কেন পারবো না?

আরটিভি: এরপর কী হলো?
টি ডব্লিউ সৈনিক: সে সময় আমার সোহেল আরমান ভাইয়ের সঙ্গে একটা ধারাবাহিকের কাজ চলছিলো। যেহেতু আমি তার লেখার খুব ভক্ত, তাই তাকেই বললাম একটা গান লিখে দিতে। তিনি রাজিও হলেন। পরে বেমালুম ভুলে গেলেন ব্যস্ততায়। আমিও ছাড়বার পাত্র নই। একদিন অন্য একটা শুটিং শেষ করে সোজা চলে গেলাম তার কাছে। শুধু তাই নয়, সে রাতে থেকেও গেলাম গান লিখে নেওয়ার জন্য। তিনি তার শুটিং শেষ করে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে গেলেন। হঠাৎ করে মধ্যরাতে তিনি উঠে বসলেন। বললেন, কাগজ-কলম আছে? তুমি থিমটা যেন কী বলেছিলে? আমি ছোট একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললাম, আমি যাকে ভালোবাসি আসলে তাকে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বা আমি তাকে পাবো না, অনিশ্চিত। কিন্তু তাকে আমি ভালোবাসি। ঘুমাতে গেলে স্বপ্ন দেখি- গানের ভাবনাটা এমন। এরপরই তিনি আমাকে লিখে দিলেন, ‘তুমি আমার ঘুম…তবু তোমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখিনা। তুমি আমার সুখ…তবু তোমায় নিয়ে ঘর বাঁধি না- এই দুই লাইন। বললেন, বাকিটা পরে।

সঙ্গে সঙ্গে আমি ইবরার টিপুকে ফোন দিলাম, সে বললো বাহ্ দারুণ তো। এরপর সকালে উঠেই চলে গেলাম তার ওখানে। সে ৫ মিনিটের মধ্যে টিউন করে ফেললো। বললো, সোহেল ভাইকে ফোন দাও। পরে তিনি এসে লিখে দিলেন, ‘তুমি আমার খোলা আকাশ, কখনো সূর্য দেখিনা, তুমি আমার দিন থেকে রাত, আমি যে সময় জানিনা...। বাকীটা লিখলেন সন্ধ্যায়। এভাবেই সৃষ্টি হলো ‘তুমি আমার ঘুম’ গান। পরে রিপন খানের স্টুডিওতে ভয়েস দিলাম। সবশেষে গান তৈরি হলে জমা দিলাম ‘বেনসন অ্যান্ড হ্যাজেজ স্টার সার্চ’ প্রতিযোগিতায়। সৌভাগ্যবশতঃ সেবার পপুলার চয়েস ক্যাটাগরিতে পেয়েও গেলাম বেস্ট অ্যাওয়ার্ড। এইতো এভাবেই শুরু।

আরটিভি: গানটি প্রকাশের পর তুমুল জনপ্রিয়তা পেলো। এতটা কী আশা করেছিলেন?
টি ডব্লিউ সৈনিক: না, সত্যিই আশা করিনি। তবে রেকর্ডিংয়ের সময় গীতিকার-সুরকার-শিল্পী ছাড়া আরেকজন গানটা প্রথম শুনেছিল। যে আমাকে বলেছিল, চাচ্চু তোমার এই গানটা হিট করবে। সে হচ্ছে আজকের হৃদয় খান। পরে দেখলাম, তার কথাটাই সত্যি হয়ে গেছে।

আরটিভি: এই গানের মাধ্যমে মানুষ আপনাকে চিনতে শুরু করলো। কিন্তু এরপর ওই অর্থে আর আপনাকে নিয়মিতভাবে গানে পাওয়া যায়নি। এর কারণ কী?
টি ডব্লিউ সৈনিক: এর পেছনে কারণ একটাই। আমি তখন ক্যামেরার কাজে ভীষণ রকম ব্যস্ত হয়ে যাই। বিশেষ করে বিজ্ঞাপনের কাজে। তবে এর মধ্যেও আমি গান যে একদম করিনি, তা কিন্তু নয়। মন মতো ভালো গীতিকবিতা খুঁজে পাইনি বলে, কাজের সংখ্যা একটু কম হয়েছে।

আরটিভি: ‘তুমি আমার ঘুম' গান নিয়ে বিশেষ কোন স্মৃতি?
টি ডব্লিউ সৈনিক: শুটিং থেকে একবার অমিতাভ রেজার সঙ্গে ফিরছি। গাড়িতে বাজতে শুরু করলো ‘তুমি আমার ঘুম’ গানটি। কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার বুলবুল বললো, ভাইয়া এটা কার গান? অমিতাভ বললো, কেন তুমি জানো না? এটাতো সৈনিকের গান। শুনে সে চুপ হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর আবারও তার জিজ্ঞাসা, আসলেই উনি গাইছেন গানটা? এবার আমি জবাব দিলাম, জ্বি ভাই আমিই গেয়েছি। পরক্ষণেই তার জবাব, গানটার সঙ্গে আসলে আপনার চেহারাটা যায় না। তখন আমি চিন্তা করলাম, উনি হয়তো ভেবেছিলেন গানটা তরুণ কেউ গেয়েছেন। তিনি মনের মধ্যে তেমনই একটা অবয়ব চিন্তা করেছিলেন। এরপর আমাকে দেখে খানিকটা আশাহত হয়েছেন। এমন অনেক ঘটনাই আছে স্মৃতির ঝুলিতে। আরেকবার অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরাতে গিয়েছি একটি অনুষ্ঠানে। সেখানে ‘তুমি আমার ঘুম’ গানটি গাওয়া হলো। পরে তাদের কাছে যখন জানতে চাওয়া হলো, গানটি কে গেয়েছেন জানেন? একেকজন একেকরকম উত্তর দেন। কেউ বলেন অর্ণব গেয়েছেন, কেউ বলেন হৃদয় খান। পরে যখন আমাকে ডেকে পরিচিত করা হলো, তখন সে কী অবস্থা। সবাই আমার সঙ্গে ছবি তুললো, গল্প করলো।

এরকম আরও একটা ঘটনার কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, একবার চট্টগ্রাম গিয়েছি শুটিংয়ের কাজে। কিন্তু লোকেশনে কোনভাবেই শুটিং করতে পারছিলাম না উৎসুক মানুষের কারণে। তারা সবাই মোশাররফ করিম, সোহেল খানকে দেখতে ভিড় করছিলেন। সে সময় নাটকের পরিচালক চিৎকার করে বললেন, সৈনিক ভাই যেভাবেই হোক শুটিংটা শুরু করেন, সময় চলে যাচ্ছে। পরে সেখানকার একজন আমার নাম শুনে রীতিমত উল্লাস করে বললেন, পাইছি রে। আপনিই কে সেই ‘তুমি আমার ঘুম’ গানটি গেয়েছেন? তখন আমার মেজাজ রীতিমত বিগড়ে আছে। বললাম, গাইছি ভাই তো কী হইছে? অন্যায় করছি? এরপর তার বিনীত অনুরোধ, আপনি শুধু গানটা একবার আমাদের গেয়ে শোনান। সুষ্ঠুভাবে শুটিং শেষ করতে আপনাদের যত রকমের সহায়তা প্রয়োজন, তার সবই আমরা করবো। পরে আর কী করা। গান গাইলাম। উপস্থিত সবাইও খুব খুশি। আমার সঙ্গে সঙ্গে তারা গাইলেন। সারাদিন আমাদের অনেক ধরনের সহায়তা করেন সবাই। শুধু তাই নয়, আমাদেরকে খিচুড়ি রান্না করেও খাওয়ান।

আরটিভি: আপনার মৌলিক গান ও অ্যালবামের সংখ্যা কয়টি?
টি ডব্লিউ সৈনিক: মৌলিক গানের সংখ্যা ৩৩টি। একক অ্যালবাম ২টি (‘তুমি আমার ঘুম’ ও ‘ঘুমের পরে মেঘ’)। মিক্সড অ্যালবাম ৩টি।

আরটিভি: গানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সমর্থন কিংবা অনুপ্রেরণা কার থেকে পেয়েছেন?
টি ডব্লিউ সৈনিক: গান করার ক্ষেত্রে আমার তিনবোনই খুব অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তবে তাদের অভিযোগও রয়েছে, কেন গানটাকে পেশা হিসেবে নিলাম না। শুধুমাত্র তাদের কারণেই আমার এখনও গান গাওয়া।

আরটিভি: ক্যাসেটের যুগ মিস করেন?
টি ডব্লিউ সৈনিক: হ্যাঁ, অবশ্যই মিস করি। সেই যুগ হয়তো আর ফিরে আসবে না। আহা কী স্বর্ণ সময় ছিল।

আরটিভি: ইউটিউবের কল্যাণে যে কেউ শিল্পী হয়ে যাচ্ছে, বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
টি ডব্লিউ সৈনিক: ইউটিউবে সব গান যে খারাপ হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। ভালো কাজও হচ্ছে। আমাদেরকে ভালো কাজটাকে মূল্যায়ন করা উচিত। যারা ভালো করছে, তাদের উৎসাহ দেওয়া উচিত।

আরটিভি: কথা নির্ভর গান কি এখন হচ্ছে?
টি ডব্লিউ সৈনিক: হচ্ছে। তবে আরও হওয়া দরকার।

আরটিভি: নতুন গান কবে আসছে?
টি ডব্লিউ সৈনিক: নতুন চারটা গানের প্রস্তুতি চলছে। তবে কোন তাড়াহুড়ো নেই, আস্তে-ধীরেই এগোচ্ছি।

আরটিভি: গান নিয়ে পরিকল্পনা কী?
টি ডব্লিউ সৈনিক: গানটা আমার রক্তের ভেতরে। মনের শান্তির খোরাকও জোগায় এই গান। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি গানটাই করবো। আমৃত্যু গানটাই চালিয়ে যাবো। আর যদি কখনো সম্ভব হয়, একটা স্টুডিও করে সেখানে আমার সব গানগুলো আমি লাইভ গাইবো। সবাইকে শোনাবো।

আরটিভি: গাওয়ার পাশাপাশি আপনি নিজেও গান লেখেন। সেটা শুধুই নিজের জন্য লেখা হয়? নাকি অন্যের জন্যও?
টি ডব্লিউ সৈনিক: অপরের জন্য আসলে ওই অর্থে লেখা হয় না। তবে আমার লেখায় একটা গান মৌমিতা গেয়েছে, আরেকটা আমি আর রন্টি ডুয়েট গেয়েছি।

আরটিভি: কণ্ঠশিল্পী পরিচয়ের বাইরে আপনি একজন পেশাদার সিনেমাটোগ্রাফার। ক্যামেরার কাজ কেমন চলছে? ব্যস্ততা কেমন?
টি ডব্লিউ সৈনিক: ব্যস্ততা আছে। তবে ইদানিং একটু কম। ঈদের বেশ কয়েকটা কাজের প্ল্যানিং চলছে। ইতোমধ্যে দুটো শেষও করেছি।

আরটিভি: ক্যামেরায় আপনার উল্লেখযোগ্য কাজগুলো কী কী?
টি ডব্লিউ সৈনিক: বিজ্ঞাপনের কাজই করেছি প্রায় চারশ’র ওপরে। তাই কোনটা রেখে কোনটা বলবো বুঝতে পারছি না। তবে টেলিকম কোম্পানির বিজ্ঞাপনগুলোই বেশি সাড়া ফেলেছে। বিশেষ করে ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার’ (গ্রামীণ ফোন) ও ‘বড় হলে কিনবো, এটা দিয়ে কী গান শোনা যায়’ (সিটিসেল) বিজ্ঞাপন দুটোর প্রশংসা মানুষ এখনও করে। এর বাইরেও অনেক আছে। এই মুহূর্তে সবগুলোর নাম মনে পড়ছে না। এছাড়া সিনেমার কাজও করেছি।

আরটিভি: ভাইরালের এই যুগে এসেও 'তুমি আমার ঘুম' গানটি এখনও তুমুল জনপ্রিয়। মানুষ গুনগুনিয়ে গায়। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
টি ডব্লিউ সৈনিক: আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। আসলে এই অনুভূতিটা বলে বোঝানো যাবে না। কেননা একজন শিল্পী চান তার গান শ্রোতাপ্রিয় হোক, মানুষ তাকে চিনুক। আর মহান সৃষ্টিকর্তা সেটা আমাকে প্রথম গান ‘তুমি আমার ঘুম’ দিয়েই দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ্।

আরটিভি: সিনেমাটোগ্রাফার নাকি কণ্ঠশিল্পী কোন পরিচয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
টি ডব্লিউ সৈনিক: দুইটা পরিচয়ই আমার কাছে ভালোলাগা-ভালোবাসার। কোনোটাকে আসলে ছোট করে দেখার উপায় নেই।

আরটিভি: আপনার যে বিষয়টি মানুষ জানে না...
টি ডব্লিউ সৈনিক: আমি খুব অভিমানী। হঠাৎ করেই শামুকবাসে চলে যাই।

আরটিভি: বর্তমান সময়ের গান নিয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই...
টি ডব্লিউ সৈনিক: ভালো গান হচ্ছে। তবে মনে রাখতে হবে, ভালোর কিন্তু শেষ নেই। আমাদেরকে আরও ভালো করতে হবে। আর হ্যাঁ, অবশ্যই আরেকটা কথা ভুলে গেলে হবে না। গান ৭ দিনের কোর্স না। তাই এটিকে অন্তরে ধারণ করতে হবে। চর্চা আরও বাড়াতে হবে।

আরটিভি: গান গেয়ে অর্জন কতটুকু?
টি ডব্লিউ সৈনিক: না চাইতে অনেক পেয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। বেনসন অ্যান্ড হ্যাজেজ স্টার সার্চ, সিটিসেল-চ্যানেল আই, সিজেএফবি, বাবিসাস, ইন্দো-বাংলা মৈত্রী সম্মাননাসহ আরও কিছু সম্মাননা পেয়েছি।

আরটিভি: সিনেমায় কবে আপনার গান শুনতে পাবো?
টি ডব্লিউ সৈনিক: সিনেমায় গান করার জন্য মুখিয়ে আছি। অনেকেই কথা বলেছেন বিভিন্ন সময়ে। দেখা যাক কী হয়। ব্যাটে-বলে মিললে হয়তো হয়েও যেতে পারে।

মন্তব্য করুন

Radhuni
  • বিনোদন এর পাঠক প্রিয়