জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে ড. খলিলুর রহমানকে নিয়োগের সিদ্ধান্তটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকের মতে, সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপেক্ষা করে একজন বেসামরিক ব্যক্তির এই দায়িত্ব লাভ প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু এই ধারণাটি জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপকতা সম্পর্কে অজ্ঞতার ফল। আসুন বিষয়টিকে গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করি।
জাতীয় নিরাপত্তা বনাম জাতীয় প্রতিরক্ষা
জাতীয় প্রতিরক্ষা হলো জাতীয় নিরাপত্তার একটি উপাদান মাত্র। যদি নিরাপত্তাকে একটি বিশাল প্রাসাদ হিসেবে কল্পনা করা হয়, তবে প্রতিরক্ষা হলো তার একটি গুরুত্বপূর্ণ কক্ষ—যা শুধু সশস্ত্র হুমকি মোকাবিলায় সক্রিয় হয়। অন্যদিকে, জাতীয় নিরাপত্তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন:
১. খাদ্য, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা
২. সামাজিক সম্প্রীতি ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা
৩. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও মানবাধিকার
৪. পরিবেশগত ভারসাম্য ও সাইবার সুরক্ষা
একজন সাধারণ নাগরিকের জীবনে প্রতিরক্ষা বাহিনীর ভূমিকা পরোক্ষ, কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট বা স্বাস্থ্যঝুঁকি তার প্রতিদিনের সংগ্রাম। সুতরাং, এই জটিল নিরাপত্তা জাল বুনতে শুধু সামরিক বিশেষজ্ঞ নয়, বহুশাস্ত্রীয় দক্ষতার প্রয়োজন।
প্রশ্ন হতে পারে—কেন একজন অর্থনীতিবিদই উত্তম নিরাপত্তা উপদেষ্টা?
ইতিহাসের সকল সংঘাতের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক স্বার্থ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের জটিলতা—প্রতিটি ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সম্পদ নিয়ন্ত্রণ মুখ্য ভূমিকা রাখে। ড. খলিলুর রহমানের অর্থনীতি, আইন ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজের অভিজ্ঞতা তাকে এই প্রেক্ষাপটে হয়ত যোগ্য প্রার্থী হিসেবে বিবেচনায় আনতে পারে। তবে এমন আরও অনেক বিষয় আছে যে গুণাবলীর উপস্থিতি অধিক প্রয়োজন। মোটকথা, সাফল্য নির্ভর করবে প্রাতিষ্ঠানিক স্পষ্টতা ও ওইসব গুণাবলীর সমন্বয়ের ওপর। জাতীয় নিরাপত্তা কখনই একক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির হাতে নয়—এটি সমষ্টিগত প্রজ্ঞার ফসল।
প্রতিরক্ষা বিষয়ে বিভ্রান্তি
সার্কুলারে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি রোহিঙ্গা ইস্যু ও প্রতিরক্ষা বিষয়ও তদারকি করবেন। এখানে একটি সাংগঠনিক বিভ্রান্তি দেখা যায়। উন্নত দেশগুলোতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পৃথক পদ। প্রতিরক্ষা কৌশল নির্ধারণে সামরিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অপরিহার্য—ঠিক যেমন একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পদার্থবিজ্ঞানের ক্লাস নিতে পারেন না।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে—তাহলে এর কার্যকরী সমাধান কী?
১. পোর্টফোলিও স্পষ্টকরণ: নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্বে অর্থনীতি, কূটনীতি ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা থাকলেও প্রতিরক্ষা কৌশল সরাসরি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে রাখা উচিত।
২. আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়: জরুরি বিষয়গুলোতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৩. সামরিক-বেসামরিক ভারসাম্য: নিরাপত্তা কাউন্সিলে সামরিক প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা।
আবার প্রশ্ন আসতে পারে—সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাই কি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার জন্য সর্বোত্তম?
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদটি শুধু কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক দূরদর্শিতার বিষয় নয়—এটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, সংঘাত ব্যবস্থাপনা ও সমন্বিত প্রতিরক্ষা কৌশলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নিচের যুক্তিগুলো বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হবে, কেন একজন অভিজ্ঞ সামরিক কর্মকর্তাই এই দায়িত্বের জন্য সর্বাধিক যোগ্য।
১. সংঘাত ও হুমকি বোঝার অভিজ্ঞতা
সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা সরাসরি যুদ্ধ, সীমান্ত সংঘাত, সন্ত্রাসবাদ ও অপ্রথাগত হুমকি (যেমন: সাইবার যুদ্ধ, জলদস্যুতা) মোকাবিলার প্রশিক্ষণ নেন। তাদের অপারেশনাল অভিজ্ঞতা জাতীয় নিরাপত্তার হুমকিকে বাস্তবসম্মতভাবে মূল্যায়নে সাহায্য করে।
উদাহরণস্বরূপ:
২০১৬ সালের গুলশান-হলি আর্টিজান হামলা: সামরিক বুদ্ধিবৃত্তিক ইউনিটের দ্রুত সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশে জঙ্গি নেটওয়ার্ক ধ্বংসে কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল।
রোহিঙ্গা সংকট: সেনাবাহিনীর মাঠপর্যায়ের জ্ঞান ও মানবিক-প্রতিরক্ষা সমন্বয় (Civil-Military Coordination) সংকট প্রশমনে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
একজন বেসামরিক উপদেষ্টা তত্ত্বীয় জ্ঞান রাখলেও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সামরিক অভিজ্ঞতা অপরিহার্য।
২. বহুস্তরীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার দক্ষতা
সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা কেবল যুদ্ধই নয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা (যেমন: সিডর, আইলা), অবকাঠামো উন্নয়ন, এমনকি কূটনৈতিক আলোচনায় (UN শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে) অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়নে এই বহুমুখী দক্ষতা প্রয়োজন। কারণ, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা-নিশ্চিত করতে সমুদ্রসীমা রক্ষা (ব্লু ইকোনমি) বা ট্রানজিট চুক্তির মতো বিষয়গুলোর সঙ্গে সামরিক কৌশল জড়িত। সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কোর বা নেভাল ইন্টেলিজেন্সের মতো ইউনিটগুলোর জ্ঞান কাজে লাগে।
৩. আন্তঃবাহিনী ও আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়
নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হয়। একজন জেনারেল ইতিমধ্যেই সামরিক কমান্ড চেইন, যোগাযোগ প্রোটোকল এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাথে পরিচিত।
উদাহরণ:
সীমান্তে হামলা ঘটলে দ্রুত প্রতিক্রিয়ার জন্য সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর সমন্বয় প্রয়োজন। জরুরি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি (যেমন: রাজনৈতিক অস্থিরতা) সামাল দিতে সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কের গভীর বোঝাপড়া প্রয়োজন।
৪. গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণে পারদর্শিতা
সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও অপ-ডিসিশন মেকিং-এ প্রশিক্ষিত। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এই দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রতিপক্ষের কৌশল (যেমন: ভারত-চীন সীমান্ত উত্তেজনা বা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা) বোঝার ক্ষেত্রে সামরিক বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ অপরিহার্য। সাইবার হুমকি বা অর্থনৈতিক নজরদারির (যেমন: হাওয়ালা ট্রানজেকশন) মতো জটিল বিষয়েও সামরিক গোয়েন্দা ইউনিটগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগে।
৫. নিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রীয় আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা
সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় নীতির প্রতি আনুগত্যের শপথ নেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হওয়া প্রয়োজন—যেখানে সামরিক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও সংস্কৃতি তাদের দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত রাখে।
যুক্তির পাল্টা জবাব: বেসামরিক উপদেষ্টার সীমাবদ্ধতা অর্থনীতি বা কূটনীতিতে পারদর্শী একজন বেসামরিক ব্যক্তি নিম্নলিখিত কারণে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন।
১. প্রতিরক্ষা কৌশলের বাস্তবতা না বোঝা: তত্ত্বীয় জ্ঞান থাকলেও যুদ্ধের ময়দানের গতিশীলতা বোঝা কঠিন।
২. সামরিক বাহিনীর সাথে কার্যকর সমন্বয়ের অভাব: বেসামরিক কর্তৃপক্ষের আদেশে সামরিক ইউনিটগুলোর সাড়া দেওয়ার গতি কম হতে পারে।
সামরিক অভিজ্ঞতাই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার জন্য সর্বোত্তম। সামরিক বাহিনীর ‘ফাস্ট ডিসিশন’ ক্যাপাবিলিটি জাতীয় সংকটে ৩ গুণ বেশি কার্যকর এবং গবেষণায় প্রমাণ: সামরিক নেতৃত্বাধীন দেশগুলোতেই নিরাপত্তা ঝুঁকি কম আর তাই বিশ্বের অধিকাংশ দেশে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হচ্ছেন সামরিক ব্যক্তিত্ব? জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদটি যখন একজন সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার হাতে থাকে, তখন তা কেবল একটি নিয়োগই নয়—এটি রাষ্ট্রের জন্য একটি কৌশলগত সুবিধা।
‘নিরাপত্তা’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ একজন সেনা কর্মকর্তা জানেন নিরাপত্তা মানে শুধু বৈঠক কক্ষের আলোচনা নয়, বরং রক্তক্ষয়ী সংঘাতে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা। সৈনিকদের জীবন বাঁচানোর দায়িত্ব পালন এবং জাতীয় সম্মান রক্ষার বাস্তব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা।
পরিসংখ্যান
বিশ্বের ৮০ শতাংশ দেশে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হচ্ছেন প্রাক্তন সামরিক ব্যক্তিত্ব (US, Russia, China, India-সহ)
সুপারিশ
একটি সমন্বিত মডেল- যদি একজন বেসামরিক ব্যক্তিকেই নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হয়, তবে তার সঙ্গে একজন সামরিক প্রতিনিধি (প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা) যুক্ত করা উচিত, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের National Security Council-এ Military Adviser থাকেন।
জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়নে সামরিক বাহিনীর মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা, বহুস্তরীয় হুমকি বিশ্লেষণের ক্ষমতা এবং আন্তঃসংস্থা সমন্বয়ের দক্ষতা অপরিহার্য। ড. খলিলুর রহমানের মতো বেসামরিক বিশেষজ্ঞের অর্থনৈতিক দূরদর্শিতা গুরুত্বপূর্ণ হলেও একজন জেনারেল বা এডমিরালের নেতৃত্বে একটি টিম জাতীয় নিরাপত্তাকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
মূল বক্তব্য
নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদটি শুধু নীতি প্রণয়নের নয়—বাস্তব মাঠপর্যায়ের সংঘাত মোকাবিলারও। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা এই দ্বৈত চাহিদা পূরণের সর্বোত্তম সমাধান। জাতীয় নিরাপত্তা কোনো একাডেমিক ডিবেট নয়—এটি একটি ‘লাইফ অ্যান্ড ডেথ’ কমান্ড সেন্টার, যার নেতৃত্বের জন্য সমরবিদ বা অভিজ্ঞ যোদ্ধারাই অধিক যোগ্য।
নোট
রাজনীতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা নিয়ে আমার একাডেমিক জ্ঞান (পড়াশোনা), অভিজ্ঞতা, গবেষণা ও ইতিহাস পর্যালোচনার মাধ্যমে যতটুকু ক্ষুদ্র জ্ঞান আছে তারই আলোকে উল্লিখিত বিষয়টি নিয়ে এই লেখা।
লেখক: নিরাপত্তা বিশ্লেষক
আরটিভি/আরএ/এআর