ঢাকাবুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১০ বৈশাখ ১৪৩২

অগ্নিস্নানে শুকিয়ে যাক অন্যায়-অনাচার

সিরাজুল ইসলাম

সোমবার, ১৪ এপ্রিল ২০২৫ , ০৩:৫৯ পিএম


loading/img
সিরাজুল ইসলাম

আজ পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ। আড়ম্বরপূর্ণভাবেই সারাদেশে দিনটি উদযাপিত হচ্ছে। দেশজুড়ে বইছে উৎসবের আমেজ। যুগ যুগ ধরে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়ে থাকে দিনটিতে। বাঙালির এই চিরায়ত উৎসবে নানা সম্প্রদায় আয়োজিত উৎসবে কিছুটা হেরফের দেখা গেলেও মূল উসব নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয় একই প্রক্রিয়ায়। এই দিনে বাঙালির প্রত্যাশাও থাকে অনেক। জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ ভুলে সবাই মেতে ওঠে উৎসবে।

বিজ্ঞাপন

নতুন বছরের শুরুতে নতুন পোশাক এবং উন্নতমানের খাবারও আয়োজন করা হয়। মেলা আয়োজন করা হয় প্রায় সব স্থানে। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরা হয় এসব আয়োজনে। অনেক স্থানে কবি, জারি, সারি, ভাওয়াইয়া ও বিচার গানের আয়োজন করা হয়।

এছাড়া বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক আয়োজন তো থাকেই। তবে কয়েক বছর আগে ‘পান্তা ইলিশ’র যে প্রচলন হয়েছিল, সেই আয়োজনে অবশ্য কিছুটা ভাটা পড়েছে। এটা যে বাংলা সংস্কৃতির অংশ নয় এবং বাণিজ্যিকভাবেই এটার প্রচলন করা হয়; সেটা বোঝাতে সক্ষম হচ্ছেন আমাদের সংস্কৃতিবিদরা।

বিজ্ঞাপন

কারণ আমাদের যে কৃষক, শ্রমিক, মজুর সকালে পান্তা ভাত খেয়ে পেটের ক্ষুধা নিবারণ করেন, দিন শুরু করে; তার পক্ষে কী আদৌ ভাজা ইলিশ মাছ খাওয়া সম্ভব? এই প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। কয়েক বছর ধরে অনেকেই পান্তা ভাতের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের শাক, বড়া কিংবা ভাজা অন্য মাছের টুকরো রাখছেন। তারপরও পান্তা ইলিশের যে আয়োজন কিংবা চাহিদা নেই, তা বলা যাবে না। অনেকেই এই আয়োজন করে থাকেন। এটাকে স্রেফ বিলাসিতা-ই বলতে হবে।

নতুন বছরে চোখে পড়ার মতো একটা বিষয় হলো লুঙ্গি পরা, ফতুয়া পরা এবং গলায় নতুন গামছা ঝোলানো। কৃষি প্রধান দেশের কৃষকের সঙ্গে অন্তত একটা দিন পোশাকে মিল রাখার এই চেষ্টা ভালো উদ্যোগ বলেই মনে করি। তবে কৃষকের প্রতি এই ভালোবাসা যদি সত্যিই থাকে; সেটা আমাদের জন্য অনেক বড় অর্জন হবে। কেননা, আমাদের পূর্ব পুরুষরা কৃষক হলেও সেই পরিচয় দিতে আমরা অনেকে ‘লজ্জা পাই’। আমরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি নিজেকে কর্পোরেট অফিসের কর্মকর্তা, জজ-ব্যারিস্টার বা ব্যবসায়ীর ছেলে হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে। নিজের শেকড়কে যে ভুলে যায়, সে আর যা-ই হোক, ভালো মানুষ নয়। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

এবার একটা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে আনন্দ শোভাযাত্রা। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই এ নিয়ে বিষোদগার করছেন। অনেকে মঙ্গলবারের নাম পরিবর্তন করে আনন্দবার লিখছেন। বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তি রয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিজ্ঞাপন

প্রত্যেকটি উৎসবের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতির একটা যোগসূত্র থাকে। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়। খুন-খারাবি, চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি ব্যাপকহারে বেড়ে যায়।

এবারের ঈদুল ফিতরে অনেকে বাসা-বাড়ির নিরাপত্তার অভাবে গ্রামের বাড়িতে যায়নি বলে পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে। যদিও তাদের সেই আশঙ্কা সত্যিই হয়নি। ঈদের ছুটিতে ফাঁকা ঢাকায় চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির তেমন খবর পাওয়া যায়নি। তার মানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে। অবস্থার আরও উন্নতি হউক সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

তবে কয়েক মাস ধরে ধর্ষণের মহামারী চলছে। প্রতিদিনই পত্রপত্রিকার পাতা খুললেই ধর্ষণের খবর চোখে পড়ছে। কোথাও কোথাও স্থানীয়রাই ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলেছেন। 

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বলছে, গত মার্চ মাসে ৪৪২ জন নারী ও কন্যাশিশু নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৬৩ জন নারী ও কন্যা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে ১৮ জন কন্যা শিশুসহ ৩৬ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন; ২ জন কন্যা শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ২ জন কন্যা শিশু ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছে।

এ ছাড়া ৫৫ জন কন্যা শিশুসহ ৭০ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। অপর দিকে ২০২৪ সালে ৫১৬ কন্যা শিশু ও নারী ধর্ষণের শিকার হন। এ বছর প্রথম দুই মাসেই (জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) ৯৭ কন্যা শিশু ও নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ১৬টি জাতীয় পত্রিকা এবং বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল থেকে নেওয়া তথ্য নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে মহিলা পরিষদ।

এই প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ বছরের প্রথম দুই মাসে ৯৭ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এছাড়া তৃতীয় মাস অথাৎ মার্চে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৬৩ জন; যা আগের দুই মাসের তুলনায় দেড়গুণের বেশি।

অন্যদিকে গাজায় ১৭ মাস ধরে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। ফিলিস্তিনের এই ভূখণ্ড এখন ধ্বংসস্তূপ। অধিকাংশ ভবন মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। প্রাণ গেছে ৬০ হাজারের বেশি মানুষের। আহত হয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের আহ্বান সত্ত্বেও তাদের হামলা থামছে না। সেখানে খাদ্য, পানীয় ও ওষুধ সংকট মারাত্মক রূপ নিয়েছে। হাসপাতালও নেই বললেই চলে। নিহতের একটা বড় অংশ নারী ও শিশু।

একদিকে বোমার আঘাত; অন্যদিকে খাদ্য সংকট, সব মিলিয়ে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। অব্যাহত এই হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার ঢাকার রাস্তায় নেমে এসেছিলেন কয়েক লাখ মানুষ। তারা ইসরায়েলের বিচার দাবি ও হামলা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ঠিক এমনই একটি পরিস্থিতিতে আজ উদযাপিত হচ্ছে বাংলা নববর্ষ।

সুতরাং এই উৎসবের রং কিছুটা হলেও ফ্যাকাসে হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। তারপরও বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান- ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি, আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক। এসো হে বৈশাখ এসো, এসো...’ উচ্চারিত হবে আমাদের কণ্ঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো আমরাও প্রত্যাশা করি পহেলা বৈশাখের অগ্নিস্নানে পৃথিবী শুচি হবে। গাজায় ইসরায়েলের হামলা বন্ধ হবে। এদেশ থেকে খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, সব বিদায় নেবে। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা। শুভ নববর্ষ।

লেখক:  বার্তা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ।

আরটিভি/এএইচ

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন

Loading...


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |