বহু বছর ধরেই আমাদের জাতীয় বাজেটে নতুন কিছু থাকে না। কেবল কিছু পণ্যে কর বাড়ানো-কমানো এবং কিছু পণ্যে কর আরোপ-তুলে দেওয়া হয়। সরকারি দলের লোকজন বাজেটকে গণমুখী দাবি করে তৃপ্তির ঢেকুর গেলেন আর বিরোধীরা প্রত্যাখ্যান করেন। বাজেটের পক্ষে-বিপক্ষে মিছিলও করা হয়। এটাই বাজেটের চিরাচরিত দৃশ্য। কিন্তু নানা আলোচনা-সমালোচনার পরও প্রায় শেষতক সব বাজেটেই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়। এ নিয়ে সরকারকে সমালোচনাও সহ্য করতে হয়। তবুও এই সুযোগ সব সরকারই রাখে ‘অদৃশ্য’ কারণে।
সরকারের তরফে আগে দাবি করা হতো, কালোটাকা সাদা করা হলে অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। এই টাকা বিনিয়োগ হলে কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু বাস্তবে এর তেমন প্রতিফলন দেখা যায় না। অবশ্য সেই দাবি থেকে সরকারগুলো বহু বছর আগেই সরে এসেছে। কেননা, সুযোগ দেওয়ার পরও কালোটাকা সাদা করার নজির তেমন নেই। পরে অবশ্য কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয় ফ্ল্যাট-প্লট প্রকল্পে।
এবারের বাজেটও এর ব্যতিক্রম নয়। যদিও এটা দলীয় সরকার নয় এবং আশা করা হয়েছিল, সরকার এবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখবে না। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আওয়ামী লীগ কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রেখেছিল। কিন্তু গত বছরের ২৯ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদ এই সুযোগ বাতিল করে দেয়। (বিবিসি, ৩০ আগস্ট ২০২৪)। সুতরাং, ধরে নেওয়া হয়েছিল এবারের বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে না। কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি পড়তে সময় লাগেনি। ৩ জুন পেশ করা জাতীয় বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রেখেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
টিআইবি’র (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) গবেষণা বলছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে প্রায় ৪৭ হাজার কোটি কালোটাকা সাদা করা হয়েছে। এটা খুবই নগণ্য। কেননা, দেশে কালোটাকার পরিমাণ ১২ লাখ কোটির মতো।
টিআইবি’র এই গবেষণাতেই স্পষ্ট যে, সুযোগ পাওয়ার পরও কালোটাকা সাদা করার আগ্রহ খুব একটা নেই। এর পেছনে দুটো কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, কালোটাকা সাদা করার মাধ্যমে অবৈধ উপার্জন স্বীকার করে নেওয়া। ভবিষ্যতে দুর্নীতিবাজ হিসেবে বিপদে পড়ার আশঙ্কা। দ্বিতীয়ত, কর ফাঁকি দেওয়া। এদেশের মানুষের কর ফাঁকি দেওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো কালোটাকা কী? টাকা কীভাবে কালো হয়? অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কালো টাকার বিষয়টি দু’রকমের হয়। কেউ যদি অবৈধভাবে উপার্জন করেন, তাহলে সেটি কালো টাকা। অবৈধ উপার্জনের বিষয়টি সাধারণত আয়কর নথিতে দেখানো হয় না। এছাড়া অনেকে হয়তো বৈধভাবে আয় করেছেন; কিন্তু আয়কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য সব টাকা বা সম্পদ আয়কর নথিতে দেখাননি। তখন সেটি কালো টাকা হয়ে যায়।
বিগত সরকার মূলত অবৈধভাবে অর্জিত কালো টাকাকে অপ্রদর্শিত আয় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে আসছিল। দেশে প্রথম কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। এরপর ১৭ বার সেই সুযোগ পায় অপ্রদর্শিত অর্থের মালিকরা। অথচ এটা সংবিধান পরিপন্থী।
সংবিধানে অধিকার ও কর্তব্য বিষয়ে ২০(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কর্ম হইতেছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয়, এবং “প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী” এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।’ এর পরের অনুচ্ছেদে অর্থাৎ ২০(২)-এ বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবে, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না এবং যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিমূলক ও কায়িক-সকল প্রকার শ্রম সৃষ্টিধর্মী প্রয়াসের ও মানবিক ব্যক্তিত্বের পূর্ণতর অভিব্যক্তিতে পরিণত হইবে।’
এ থেকে প্রতীয়মান হয় কর্ম করে বৈধভাবেই অর্থ-সম্পদ অর্জন করতে হবে। অন্য উপায়ে অর্জিত অর্থ-সম্পদ অবৈধ এবং রাষ্ট্র সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। তাহলে সংবিধান লঙ্ঘন করে সরকার কেন ১৭ বার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিল? এর সাধারণ উত্তর হতে পারে অর্থনীতির গতি সঞ্চার করা এবং বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ করা।
বাস্তবে এর কিছুই হয়নি। কালোটাকা দেশে বিনিয়োগ হয়নি। বরং প্রতি বছর বিপুল টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। গত বছরের ৩১ আগস্ট ওয়াশিংটনভিত্তিক আর্থিক খাতের গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য বলছে, বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতি বছর ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। শুধু ব্যক্তি উদ্যোগেই নয়, অর্থ পাচার প্রক্রিয়ায় পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়েছে দেশের একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকও।
অন্যদিকে, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, গেল প্রায় দেড় যুগে দেশীয় ১৯টি ব্যাংকে আত্মসাৎ করা মাত্র ২৪টি ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমেই প্রায় একশ হাজার কোটিরও বেশি টাকা পাচার হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
আসলে কালোটাকা সাদা করার সুযোগের জন্য সরকারের ওপর অদৃশ্য রাজনৈতিক চাপ থাকে। কিন্তু বর্তমান সরকার তো অরাজনৈতিক। তারা কেন কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিল? বৈষম্যবিরোধী যে আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে এই সরকার ক্ষমতাসীন হলো, এই সুযোগ নিঃসন্দেহে সেই নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, সরকার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে, যা অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থী।
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকার দুর্নীতিকে উৎসাহ দিয়ে রিয়েল এস্টেট লবির ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে আবাসন খাতে অবৈধ অর্থের মালিকদের অধিকতর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সৎ উপার্জনকারীদের ফ্ল্যাট বা ভবনের অংশীদার হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে।
আবাসন খাতকে দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি। কালোটাকার উৎস অনুসন্ধান করে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা, করব্যবস্থায় সমতা ও ন্যায় নিশ্চিতের দাবিও জানান তিনি।
এ দেশে জমি ও ফ্ল্যাটের দাম হুহু করে বাড়ছে। শুধু মহানগরী নয়, প্রত্যন্ত গ্রামেও জমির দামে আগুন। ১০ বছর আগে যে জমির দাম ছিল ২০ হাজার টাকা শতাংশ, এখন তা লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। এর নেপথ্যে কালোটাকার দাপট। ঢাকা শহরে তো কোটি টাকার নিচে ফ্ল্যাট কল্পনাও করা যায় না। এই টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনার সামর্থ্য কয়জনের আছে?
রাষ্ট্র কালোটাকার মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। উল্টো তাদের সম্পদের পাহাড় গড়ার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। এর মধ্যদিয়ে রাষ্ট্র কিন্তু দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে; যা সংবিধান পরিপন্থী। দুর্নীতিবাজদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ নয়; তাদের রুখে দিতে হবে, আইনের আওতায় আনতে হবে।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ।
আরটিভি/আইএম