ঢাকাবৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২

অগ্নিস্নানে ঝলসে ওঠা মধ্যপ্রাচ্য: তেহরান থেকে তেল আবিব

সাখাওয়াত মজুমদার

সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫ , ১১:১১ পিএম


loading/img
ছবি: সংগৃহীত

তেহরানের আকাশে জ্যোৎস্না নয়, শীতল আলোর বদলে নামে আগুন। ১২ জুন, ভোর সাড়ে তিনটা, ঘুমন্ত নগরীতে বেজে ওঠে বিস্ফোরণ। ইসরায়েলি বাহিনীর ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ অভিযান যেন পারস্য মাটিতে নিক্ষিপ্ত আগ্নেয় এক ঘোষণা ‘আমরা এসেছি, তোমার নিঃশ্বাসে আগুন ঢালতে।’

বিজ্ঞাপন

তেহরানের ১৮ নম্বর জেলা, আধা আবাসিক, আধা সামরিক—সেখানে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে পড়ে একের পর এক বোমার ভারে। একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা কিশোরের চোখে শেষ দৃশ্য ছিল আগুনের বলয়। ইসরায়েল বলে, ‘আমরা নাতাঞ্জের কেন্দ্রবিন্দুতে আঘাত করেছি, যেখানে থেকে উঠে আসছে সেই ইউরেনিয়াম, যে কিনা বিশ্বকে উল্টো ঘুরিয়ে দিতে পারে।’ নেতানিয়াহু উচ্চারণ করেন, ‘এটা অস্তিত্বের লড়াই।’

পাল্টা বজ্র: ইরানের প্রতিশোধ
তেহরানের ধোঁয়া না মুছতেই ‘ট্রু প্রমিস ৩’ শুরু করে ইরান। এটা আর স্রেফ হামলা নয়-এ যেন এক প্রতিশোধের কাব্য, যেখানে প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র চিৎকার করে বলে, ‘আমরা রক্ত চাই না, কিন্তু ন্যায় চাই।’ ইরান ছুড়ে দেয় শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র- তেল আভিভ, হাইফা, রিশন লে সিওন, বাত ইয়ামের রাত আর আলোকিত নয়, আলোর বদলে নামে এক লাল মৃত্যু। আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা দেয়, কিন্তু মানুষের হৃদয়ের কাঁপন কে প্রতিরোধ করবে? ইরান দাবি করে, ‘আমরা কেবল সামরিক ঘাঁটিতে আঘাত হেনেছি।” কিন্তু মৃত্যু তো সামরিক কিংবা বেসামরিক চেনে না।

বিজ্ঞাপন

নেতৃত্বে ছায়া, কূটনীতিতে অন্ধকার

এই লড়াইয়ের মাঝখানে জড়ায় আরও একটি ছায়া: হোয়াইট হাউজ। ডোনাল্ড ট্রাম্প-একসময়ের চুক্তির প্রতিশ্রুতি দানকারী, এবার বলছেন, ‘আমি শান্তির জন্য ফিরছি না। আমি চাই আত্মসমর্পণ।’ জিই৭ সম্মেলন থেকে বেরিয়ে এয়ার ফোর্স ওয়ানে উঠে ট্রাম্পের ঘোষণা, ‘আমরা জানি খামেনি কোথায় আছেন, কিন্তু এখনই নয়।’ পাশাপাশি খবর ফাঁস হয়, ইসরায়েলের এক প্রস্তাব তিনি নাকচ করেছেন, ‘না, খামেনিকে এখন হত্যা করা যাবে না।’ শুধু এখন? নাকি এও এক রাজনৈতিক তাস? এদিকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেন, ‘যদি তোমরা আমাদের শিকড় স্পর্শ করো, আমরা তোমাদের মাটি সোঁদা করব রক্তে।’ 

দুই পক্ষই দাবি করে ‘ন্যায়’-এর, কিন্তু মরছে কারা?
২২৪টি নাম; তেহরানের মর্গে পড়ে আছে। কেউ বাবা, কেউ ভাই, কেউ কেবল পথ চলতি মানুষ,  তাদের পরিচয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাদের নাম লেখা হয় লাল কালি দিয়ে বিবিসির রিপোর্টে। ইসরায়েল হারিয়েছে ২৪ জন, তাদের মধ্যে কেউ ছিল শিক্ষক, কেউ বৃদ্ধ, কেউ ট্যাক্সিচালক। তাদের বাড়িতে আজ খাবার টেবিলে একজনের প্লেট খালি পড়ে আছে, অথচ কেউ আর চামচ তোলে না। একটা যুদ্ধ শুরু হয় পারমাণবিক ‘হুমকি’ দিয়ে, শেষ হয়, না, শেষ হয় না,  চলতে থাকে একেকটা শোকাবহ স্মৃতির মতো, যার কোনো দিনপঞ্জি নেই, কোনো ব্যাখ্যা নেই। 

বিজ্ঞাপন

পারমাণবিক ছায়া, নৈতিক অন্ধকার
আইএইএ বলে, ‘ইরান আমাদের আস্থা ভঙ্গ করেছে।’ তারা ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সংরক্ষণ করছে, যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে শুধু একটি পদক্ষেপ দূরে। বিশ্ব সন্দিহান-ইরান বারবার বলছে, ‘আমরা শান্তির জন্য কাজ করছি।’ কিন্তু শান্তি কি শুধু ঘোষণা দিয়ে আসে? যে অঞ্চল এক দশক আগেও আগুনে পুড়েছিল, সেখানে আজ আবার ছাই উড়ছে। এ আগুন শুধু ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে নয়, এটা গোটা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে রক্ত ঢালছে।

বিজ্ঞাপন

ভবিষ্যতের প্রতি আশঙ্কা: শেষ নাকি শুরু?
এই যুদ্ধের শেষ কোথায়? তেহরানের দেয়ালে লেখা হচ্ছে মৃত্যু কবিতা। তেল আভিভে রাত জেগে শিশুরা শোনে বোম শেল শব্দের লয়। এই লড়াই কি শুধুই জ্বালাময়ী রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া? না কি এ এক ভবিষ্যতের ভয়াবহ সংকেত? বিস্মিত বিশ্ব তাকিয়ে আছে,  হয়তো কোনো একটি ভুল বোতামে চাপ পড়লেই, এই যুদ্ধ পারমাণবিক চূড়ান্ততায় পৌঁছে যাবে। আর তখন ইতিহাস আমাদের আর ক্ষমা করবে না।

যুদ্ধের গর্ভে মানুষ হারিয়ে যায়
এই যুদ্ধ রাজনীতি, ধর্ম, ভূরাজনীতি কিংবা জ্বালানি নিয়ে নয় কেবল,  এ যুদ্ধ মনুষ্যত্বের বিরুদ্ধে। ইরান-ইসরায়েল এখন শুধু শত্রু নয়, তারা একে অন্যের আয়নায় নিজেদের ধ্বংস দেখছে। আমরা সবাই চায়েছিলাম শান্তি, কিন্তু সেই পথে ছিল পেছনে আগুনের রেখা। এখন সময় জিজ্ঞেস করার,  ‘কয়টি শিশু মরলে যুদ্ধকে আমরা যথার্থ বলি?’

লেখক: কলামিস্ট ও ব্যাংকার

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন
Advertisement
Advertisement


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |