একটা সময় ছিল যখন সকালটা শুরু হতো সজীবতায়। হাঁটা, অফিস, পরিবার, সব কিছুই ছিল ভারসাম্যপূর্ণ। হঠাৎ যেন কিছু একটা বদলে যেতে শুরু করল। শরীর ক্লান্ত, মন অস্থির, ওজনও বাড়ছে যেন নিজের ইচ্ছেমতো। চুল পড়ে, ঘুম আসে না, কখনও মনটাই খারাপ থাকে সারাদিন। কিন্তু কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না? হতে পারে, এই সবকিছুর পেছনে কাজ করছে আপনার শরীরের ভেতর থাকা এক ছোট্ট কিন্তু শক্তিশালী গ্রন্থি—থাইরয়েড। আমরা অনেকেই জানি না, এই থাইরয়েড গ্রন্থিটি ঠিকঠাক না চললে শরীর ‘নিজের সঙ্গে’ লড়তে শুরু করে।
আজ ২৫ মে, বিশ্ব থাইরয়েড দিবস। চলুন, এই সুযোগে একটু ভালো করে চিনি আমাদের শরীরের এই নিঃশব্দ নিয়ন্ত্রককে।
থাইরয়েড কী, কেন এত গুরুত্বপূর্ণ
থাইরয়েড গ্রন্থি শরীরের বিপাক ক্রিয়া, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, মনস্তাত্ত্বিক ভারসাম্য এবং শক্তি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু যখন এই গ্রন্থির হরমোন নিঃসরণে ব্যাঘাত ঘটে, তখন তা শরীর ও মনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
২০০৮ সালে ইউরোপিয়ান থাইরয়েড অ্যাসোসিয়েশনের (ইটিএ) উদ্যোগে বিশ্ব থাইরয়েড দিবসের সূচনা হয়। পরবর্তীতে এতে যুক্ত হয় আমেরিকান, এশিয়া-ওশেনিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকান থাইরয়েড সংস্থাসমূহ। প্রতিবছর ২৫ মে এই দিনটি পালিত হয়।
দিবসটির উদ্দেশ্য
- থাইরয়েডজনিত রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি
- রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করার গুরুত্ব তুলে ধরা
- সঠিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যপরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা বোঝানো
- রোগীদের তথ্যপ্রাপ্তি ও সহায়তা সহজতর করা
কীভাবে এই দিবস পালন করতে পারেন?
- চেকআপ করুন: নিজের বা পরিবারের সদস্যদের থাইরয়েড পরীক্ষা করুন
- সচেতনতামূলক কার্জক্রমে অংশ নিন: স্থানীয় বা অনলাইন সেমিনারে যুক্ত হয়ে উপসর্গ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানুন
- কমিউনিটিতে উদ্যোগ নিন: সচেতনতা বাড়াতে হাঁটা/সাইক্লিং ইভেন্ট আয়োজন করুন
- সামাজিক মাধ্যমে তথ্য ছড়ান: পোস্ট, ভিডিও বা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন
- রোগী সহায়তাকারী সংস্থাকে সমর্থন করুন: স্বেচ্ছাসেবক হোন বা আর্থিকভাবে সাহায্য করুন
থাইরয়েড সমস্যা এত নিঃশব্দ কেন?
থাইরয়েড রোগের লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে দেখা দেয় এবং অনেকটাই অস্পষ্ট।
- হাইপোথাইরয়েডিজম: শরীরে থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি হলে দেখা দেয় ক্লান্তি, ঠান্ডা অনুভব, ওজন বৃদ্ধি, মন খারাপ ও নিস্তেজ ভাব।
- হাইপারথাইরয়েডিজম: অতিরিক্ত থাইরয়েড হরমোন নিঃসরণে হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া, অতিরিক্ত ঘাম, নার্ভাসনেস ও ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়।
এই উপসর্গগুলোকে অনেক সময় মানসিক চাপ, ব্যস্ততা বা বয়সজনিত পরিবর্তন ভেবে উপেক্ষা করা হয়। অথচ শরীর তখনও সংকেত দিয়ে যাচ্ছে।
থাইরয়েড ও মানসিক স্বাস্থ্যের যোগসূত্র
থাইরয়েড হরমোন সরাসরি প্রভাব ফেলে মস্তিষ্কের কার্যক্রমে। তাই হরমোনের ভারসাম্যহীনতায় দেখা দিতে পারে বিষণ্নতা, মনোযোগে ঘাটতি, স্মৃতিভ্রংশ বা উদ্বেগের মতো সমস্যা। শারীরিক সমস্যার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে মানসিক অস্বস্তির আসল কারণ।
ঝুঁকিতে কারা বেশি?
থাইরয়েড সমস্যা যেকোনো বয়সে হতে পারে। তবে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন—
- নারীরা, বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় ও মেনোপজের সময়
- যাদের পরিবারে থাইরয়েড রোগের ইতিহাস আছে
- দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপে থাকা ব্যক্তি
- অটোইমিউন ডিজঅর্ডারে আক্রান্তরা
যে লক্ষণগুলোর দিকে খেয়াল রাখবেন:
- হঠাৎ ওজন বৃদ্ধি বা হ্রাস
- অতিরিক্ত চুল পড়া
- ঠান্ডা বা গরম অনুভবের প্রবণতা
- ঘুমজনিত সমস্যা
- মন খারাপ থাকা, বিষণ্নতা বা উদ্বেগ
- গলার সামনে ফোলাভাব
- শুষ্ক ত্বক বা চুলকানি
- মাসিকচক্রে অনিয়ম
নির্ণয় ও চিকিৎসা
- থাইরয়েড সমস্যা নিশ্চিত নির্ণয়ের জন্য টি৩, টি৪ ও টিএসএইচ টেস্ট করা হয়।
- প্রয়োজন হলে আলট্রাসনোগ্রাম বা বায়োপসি করা হতে পারে।
থাইরয়েড সমস্যার চিকিৎসা সাধারণত হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপির মাধ্যমে হয়। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ গ্রহণ বিপদজনক হতে পারে।একটি ছোট্ট থাইরয়েড গ্রন্থি হলেও এর ভারসাম্যহীনতা জীবনের প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করতে পারে। আজকের এই দিনটি মনে করিয়ে দেয়, সময়মতো রোগ শনাক্ত ও সচেতনতা কেবল জীবন বাঁচায় না, জীবনকে সুন্দরও করে তোলে।
আরটিভি/জেএম
