কালোত্তীর্ণ ইতিহাসকে স্পর্শ করলাম আমরা। ২৫ মার্চের বিভৎস সে কালো রাতকে এখন থেকে স্মরণ করবো 'গণহত্যা দিবস' হিসেবে। মাননীয় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী রোববার সংসদে ইতিহাসের এ বর্বরতম দিনটিকে 'গণহত্যা দিবস' হিসেবে পালনের ঘোষণা করেছেন। এজন্য তাকে অভিনন্দন। অভিনন্দন, মহান জাতীয় সংসদকেও।
যে প্রজন্ম বিকৃত ও বিভ্রান্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে, সে প্রজন্মকে সত্যানুসদ্ধানের পথ দেখানোর দূরহ কাজটি শুধু ইতিহাসবিদদের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত নয়। এক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমও হতে পারে দৃঢ় ও মজবুত হাতিয়ার। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনকে শুধুমাত্র নামসবর্স্ব চেতনায় লালন না করে প্রকৃত ইতিহাসের আলোয় উদ্ভাসিত করাও একটি জরুরি ও অপরিহার্য উদ্যোগ।
ফিরে যাচ্ছি ইতিহাসের পাতায়
২৫ মার্চের গণহত্যা সম্পর্কে ড. সালাহউদ্দীন আহমদ লিখেছেন '১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে পাকিস্তান বাহিনী বাঙ্গালি জনগণের ওপর বিশ্বাস ঘাতকের ন্যায় নিষ্ঠুর পৈশাচিকতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সংগঠিত হলো ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ নৃশংস গণহত্যা এবং ইহা বিশ্ববিবেককে গভীরভাবে নাড়া দিলো। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এ অত্যাচার প্রতিহত করতে মরণপণ করে রুখে দাঁড়ালো। শুরু হলো জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, যার পরিণতিতে সৃষ্টি হল স্বাধীন বাংলাদেশ’
(বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পটভূমি, ডক্টর সালাহউদ্দীন আহমদ, অনুবাদ : মোহাম্মদ আবদুল গোফুর)
ভারত সরকারের তৎকালীন পরিকল্পনা মন্ত্রী দূর্গা প্রসাদ ধর লিখেছেন, '১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অর্থাৎ যেদিন থেকে তারা সামরিক অভিযান শুরু করে সেইদিনই বাংলাদেশের জন্ম হয়। মানুষ যে কতখানি পশু হতে পারে সে ব্যাপারে '৭১ এর মার্চ থেকে ১৬ইং ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের দিন পর্যন্ত সময়ের ইতিহাস একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।'
(ইমার্জেন্স অব বাংলাদেশ দূর্গা প্রসাদ ধর, সোসালিস্ট ইন্ডিয়া সংখ্যায় প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে অনুবাদ : শ্রী বিনোদ দাস গুপ্ত)
গবেষক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, '১৯৭১ সালের গণহত্যা যখন শুরু হয় তখন বাংলাদেশের মানুষের মনে সবচেয়ে বেশি মর্মান্তিকভাবে বেজেছে যে ঘটনা সেটা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হত্যাকাণ্ড। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে ছিল এ ঘটনার পর নিশ্চিত জেনেছে যে, পূর্ণ স্বাধীনতা ভিন্ন অন্য কোন পথে বাঙ্গালির বাঁচার উপায় নাই।'
(বাংলাদেশ: স্বাধীনতার আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা, ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত)
নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী লিখেছেন, ‘হানাদাররা ২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে যে নির্মূল অভিযান চালায় তাতে বেছে বেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের আবাসগুলো এবং কয়েকটি পত্রিকা অফিসে বিশেষভাবে আঘাত হানে। এক হিসেব অনুযায়ী তারা শুধুমাত্র জগন্নাথ হলেই ৩৪০ জন ছাত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে (সাবেক ইকবাল হল) বীরের ন্যায় লড়াই করে ২০০ জন ছাত্র মৃত্যুবরণ করেন। বু্দ্ধিজীবীদেরও এমনি নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী, অভিযানের শুরুতেই কেবলমাত্র ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়েরই ১০ জন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদকে হত্যা করা হয়।'
(বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তি ও বৃদ্ধিজীবী দমন, ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত)
সাংবাদিক সাইমন ড্রিং ‘ওয়াশিংটন পোষ্ট’ পত্রিকায় ৩০ মার্চ ১৯৭১ সালের সংখ্যায় লিখিছেন, '২৫ মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার রাস্তায় চলমান ট্যাংকগুলোর প্রথম লক্ষ্য ছিল ছাত্ররা। নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যান্যরা নিহত। মুজিবুরের সমর্থক দু'টো সংবাদপত্র অফিস ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। মাত্র ৩০টি মৃতদেহ ইকবাল হলে দেখা গেলো। কিন্তু হলের করিডোরে যতো রক্ত দেখা গেলো তা থেকে মনে হয় না যে, নিহতের সংখ্যা এতো অল্প। সেনাবাহিনী বহুসংখ্যক মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে।’
(ঢাকা কীভাবে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের জন্য খেসারত দিয়েছে, ৩০ মার্চ-১৯৭১, অনুবাদ : মুনতাসির মামুন)
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এম আর আখতার মুকুল লিখেছেন, '১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ছিলো দারুণ ঘটনাবাহুল। সন্ধ্যার পর রাত ৯ টা নাগাদ ইয়াহিয়ার অনুমোদিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুসারে ঢাকাসহ অন্যান্য স্থানে একইসঙ্গে শুরু হলো গণহত্যা। অর্থাৎ প্রথম আক্রমনটা এলো পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর পক্ষ থেকে’
(স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে শুধু বঙ্গবন্ধুর মুখচ্ছবি, এম আর আখতার মুকুল, প্রকাশকাল ২০০০)
লে. জেনারেল জে এফ জ্যাকব লিখেছেন, '২৫ মার্চ রাত এগারোটায় বাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরের দিকে রওনা দেয় এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর গোলাগুলি শুরু করে’
(সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা, অনুবাদ : আনিসুর রহমান মাহমুদ)
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের জন্য যে আনুষ্ঠানিক সংগ্রাম শুরু হয়েছিলো, সেই পথ পরিক্রমার ৯ মাসে ৩০ লক্ষ শহীদ, সীমাহীন জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট ও লুন্ঠন এবং হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ের সে স্বাধীনতাকে এখন থেকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আরো গভীরভাবে বুকে ধারণ করে ইতিহাসকে আলিঙ্গনের সুযোগ পাবে। তাতে জয় হবে মুক্তিযুদ্ধেরই।
এসজে