হোয়াইট হাউসে প্রবেশের পথে ট্রাম্প, যা অপেক্ষা করছে বিশ্ব রাজনীতিতে
১৩২ বছরের রেকর্ড ভেঙে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তন করতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সাদা ইমারতে প্রবেশের আগে বিশ্বস্তদের নিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছেন নিজের মন্ত্রিসভা। শুধু তাই নয়, হাউস অব কংগ্রেস ও সিনেট- দীর্ঘদিন পর মার্কিন সংসদের দুই কক্ষেরই নিয়ন্ত্রণ এবার রিপাবলিকানদের দখলে। ফলে, আগের মেয়াদের তুলনায় এবার ট্রাম্প যে অনেক বেশি নির্ঝঞ্ঝাট ক্ষমতা উপভোগ করতে যাচ্ছেন, তা অনেকটাই অনুমিত। এ অবস্থায় বড় এক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে ট্রাম্পের একচ্ছত্র প্রভাব কী বয়ে আনতে যাচ্ছে বিশ্ব রাজনীতিতে?
বিশ্লেষকদের ধারণা, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের পুনরায় দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই নাটকীয় পরিবর্তনের আঁচ লাগবে ইউরোপে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘনিয়ে আসার সম্ভাবনা দেখছেন অনেকেই। তবে, ফলাফল নিয়ে হয়তো খুব একটা খুশি হওয়ার সুযোগ নেই যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্রদের। কারণ, ট্রাম্পের নীতির কারণে লাভবান হতে পারে রাশিয়া।
এটা ইতোমধ্যেই স্পষ্ট যে, ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত সামরিক বা অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়ার পরিকল্পনা মাথায় রাখছে না। এতে করে ইউরোপ বা যুক্তরাজ্যকে যুদ্ধের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, অথবা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে জাতীয় স্বার্থে একটি সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
এ ছাড়া নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বেশ কয়েকবারই স্পষ্ট করেছেন যে, তিনি রাশিয়ার সঙ্গে আরও সমস্যায় জড়াতে চান না।
নির্বাচনের আগেই ন্যাটোকে আর্থিক সমর্থন যোগানোর ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ট্রাম্প। ইঙ্গিত দিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার।
তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এরই মধ্যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে আরও একবার। গত শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) বিবিসি রেডিওকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ না করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ত্বরান্বিত করার জন্য যুক্তরাজ্যকে আহ্বান জানিয়েছেন ট্রাম্পের সিনিয়র অর্থনৈতিক উপদেষ্টা স্টিফেন মুর।
বিবিসি রেডিওর সঙ্গে কথা বলার সময় স্টিফেন মুর বলেছিলেন, ব্রিটিশ সরকার যদি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও ইইউর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে প্রাধান্য দেয়, তবে ব্রিটেনের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে যুক্তরাষ্ট্র কমই আগ্রহ দেখাবে।
এদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ঝামেলায় জড়ানোর চেয়ে চীনের আধিপত্য এবং প্রবণতাকে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ইউরোপে সীমিত করতে চান বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে, বাণিজ্য, প্রযুক্তি, মহাকাশ, শক্তি, ডিজিটালাইজেশন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে আগামীতে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির শঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, চীনের জন্য ট্রাম্পের সময়কালটা বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জিং হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীনের এই প্রতিযোগিতার ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আরও ছায়াযুদ্ধ দেখা যেতে পারে।
অবশ্য এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদার ও বন্ধু হতে ইচ্ছা পোষণ করেছে চীন। সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে সংলাপ আরও জোরদার করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত সি ফেং বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাওয়ার বা যুক্তরাষ্ট্রের জায়গায় যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই চীনের।
বাণিজ্য, কৃষি, জ্বালানি, কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা, গণস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের একসঙ্গে কাজ করার ব্যাপক সম্ভাবনা আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক অনেক উদ্বেগের বিষয় আছে। বিষয়গুলো আলোচনার টেবিলে এনে খোলাখুলিভাবে কথা বলা ও সমতাভিত্তিক সমাধানের চেষ্টা করা পুরোপুরিভাবে সম্ভব।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পররাষ্ট্র নীতি এবং জাতীয় স্বার্থের দ্বন্দ্বের বড় ধরনের প্রভাব পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ, যেমন তাইওয়ান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান, মিয়ানমার এবং ফিলিপাইনের ওপর পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন অনেক বিশ্লেষক।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও দেশটির কংগ্রেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেষ্টা চালানো হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন এক ভারতীয় আমেরিকান নেতা। আগামী বছর ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পরই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তারা কাজ শুরু করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
ভারত বড়াই নামে ওই নেতা বার্তাসংস্থা পিটিআইকে জানান, নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে পোস্ট দিয়েছিলেন, সেটি তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। আর এ বিষয়টি কাজে লাগিয়েই বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে তারা ট্রাম্পকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করবেন।
বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে ট্রাম্পের কাছে পৌঁছাতে ভারতীয় আমেরিকানরা সক্রিয়ভাবে কাজ করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। বিশেষ করে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেষ্টা চালানো হবে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন এই ব্যক্তি।
ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে ইউরোপ-এশিয়ায় বড় কিছু পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে খুব একটা পরিবর্তনের আশা করা যাচ্ছে না। যুদ্ধ পরিস্থিতি হয়তো কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসতে পারে, তবে ইসরায়েলের ওপর মার্কিন প্রশাসনের আশীর্বাদ বজায় থাকবে বলেই বোঝা যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ট্রাম্পই প্রথম নেতা যিনি জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তার নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, বাইডেন প্রশাসনের চেয়ে ইসরায়েলকে বেশি সমর্থন করবেন। এ ছাড়া নেতানিয়াহুর সরকার বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের চেয়ে ট্রাম্পের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল ছিল।
ট্রাম্পের বক্তব্যে ইসরায়েলি বাহিনীর ফিলিস্তিনের ওপর আগ্রাসনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি প্রায়ই ‘শান্তি’ শব্দটি ব্যবহার করেন, তবে ইসরায়েলের বর্বরোচিত একতরফা আগ্রাসন বন্ধের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সুস্পষ্ট মন্তব্য এড়িয়ে যান।
এ অবস্থায় এটা অনেকটাই স্পষ্ট যে, মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে যে পদক্ষেপই নেন না কেন ট্রাম্প, সেটা যুদ্ধের স্থায়ী সমাধান বয়ে আনছে না বা ইসরায়েলি আগ্রাসনে কোনো শক্ত লাগাম টানছে না। বরং, তিনি সম্ভবত ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ বা আব্রাহাম চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করবেন।
এ ছাড়া তেহরানের পারমাণবিক চুক্তির বিষয়েও কোনো কূটনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। যদিও ইরান-ইসরায়েল বা ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা কম, তবে ছোট-পরিসরে সংঘাত নিয়মিত হয়ে উঠতে পারে এবং এটি অঞ্চলের অস্থিরতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে।
আরটিভি/এসএইচএম-টি
মন্তব্য করুন