গোপন কারাগারে যেভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন সৌদি নারীরা

আরটিভি নিউজ

রোববার, ০৮ জুন ২০২৫ , ০৬:২৭ পিএম


গোপন কারাগার
ছবি: সংগৃহীত

একজন তরুণীর পরনে কালো আবায়া। তাকে দেখা গেছে সৌদি আরবের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি শহরে দ্বিতীয় তলার জানালার কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকতে। আরেকটি ছবিতে দেখা গেছে, তাকে ক্রেনের সাহায্যে নিচে নামিয়ে আনা হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

সৌদি আরবে শত শত নারী পরিবার ও স্বামীর পক্ষ থেকে অবাধ্যতা, সামাজিক নিয়ম ভঙ্গ, বা বাড়ি থেকে অনুপস্থিত থাকার অভিযোগে গোপনীয়তা বজায় রেখে পরিচালিত ‘পুনর্বাসন কেন্দ্র’ বা দার আল-রেয়া নামক প্রতিষ্ঠানে বন্দী রয়েছেন। 

গার্ডিয়ানের এক বিস্তারিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সেখানে নারীরা ‘নারকীয়’ পরিবেশে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন। যেখানে তাদের ওপর সাপ্তাহিক চাবুকের দণ্ড, জোরপূর্বক ধর্মীয় শিক্ষাদান এবং বাইরের কারো সঙ্গে যোগাযোগের নিষেধাজ্ঞাসহ নৃশংস নির্যাতন চালানো হয়। 

বিজ্ঞাপন

এই পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে বন্দী নারীরা বাধ্যতামূলকভাবে সেদেটিভ খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে বাধ্য হন। নগ্ন অনুসন্ধান করা হয় এবং তাদের কুমারীত্ব পরীক্ষা করা হয়। 

অনেকেই জানান, শুধু মাত্র প্রার্থনা না করার জন্য দণ্ডিত হয়েছেন। আবার একাকী অবস্থায় অন্য নারীর সঙ্গে থাকার অভিযোগে ‘সমকামী’ হওয়ার দোষে চাবুক খেতে হয়েছে। এমনকি, নিজের পরিবার থেকে যৌন নির্যাতন সহ্য করেও তাদের শাস্তি হিসেবে এই কেন্দ্রে পাঠানো হয়। যেখানে নারীদের ‘পরিবারের সম্মান রক্ষার’ নামে আটক রাখা হয়।

নির্বাসনে থাকা অধিকারকর্মী সারা আল-ইয়াহিয়া জানিয়েছেন, তিনি কয়েকজন বন্দীর সঙ্গে কথা বলেছেন, যারা বলছেন তারা একা, ভীত এবং হুমকির মুখে রয়েছেন। ইয়াহিয়া নিজেও ১৩ বছর বয়সে যৌন নির্যাতনের শাস্তি এড়াতে এই কেন্দ্রে পাঠানোর হুমকি পেয়েছিলেন। 

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘আমার বাবা আমার ওপর যৌন নির্যাতন চালাতো, আর আমাকে এই কেন্দ্রে পাঠানোর হুমকি দিয়ে তার দমন চালাতো।’

বিজ্ঞাপন

লন্ডনপ্রবাসী সৌদি অধিকারকর্মী মরিয়ম আলদোসারি বলেন, ‘একজন নারীকে ওখানে রাখা হয় যত দিন না সে পরিবারের নিয়ম মেনে চলতে রাজি হয়।’ 

যখন সৌদি আরব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সংস্কারের মুখোশ পরে ফিফা বিশ্বকাপের মতো ইভেন্ট আয়োজন করছে, তখন নারীদের অধিকারের দাবিতে মুখ খোলা নারীদের গৃহবন্দি, জেল কিংবা দেশান্তর করা হচ্ছে। এই পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো হচ্ছে নারীদের দমন করার অন্যতম গোপন অস্ত্র, যা বিশ্বের কাছ থেকে লুকানো থাকে।

মানবাধিকার সংস্থা আলক্বস্ত জানিয়েছে, এই কেন্দ্রে বন্দী নারীদের নিরাপত্তাহীনতা এতটাই গভীর যে অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। অনেক নারীর অভিযোগ, তারা পুলিশের কাছে নির্যাতনের অভিযোগ জানালেও বরং তাদের পরিবার বা অভিভাবকের ইচ্ছায় এই কেন্দ্রে বন্দী রাখা হয়েছে।

সরকার অবশ্য এই অভিযোগগুলো কঠোরভাবে অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, এই কেন্দ্রগুলো ‘আদালতের নির্দেশে’ প্রতিষ্ঠিত এবং নারীরা ‘স্বেচ্ছায়’ কেন্দ্রে আসতে পারেন। ব্যক্তিগত ও শিক্ষাগত কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারেন এবং পরিবারের অনুমতি ছাড়াই কেন্দ্রে প্রবেশ-প্রস্থান করতে পারেন। 

তবে অধিকাংশ সাক্ষ্য ও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারীরা বাস্তবে কেন্দ্রে আটকা পড়ে এবং পরিবার বা অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে মুক্ত হতে পারেন না। 

২০১৭ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান নারীদের অধিকারের জন্য কিছু সামাজিক সংস্কার এনেছেন। যেমন নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি এবং পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া দেশের বাইরে যাত্রার সুবিধা। তবে বাস্তবে নারীদের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং অধিকারে বাধা এখনও অনেক ক্ষেত্রে বজায় আছে। গত কয়েক বছরে নারীর অধিকার নিয়ে আওয়াজ তোলার অপরাধে বহু নারী দণ্ডিত হয়েছে। 

এই বিশ্লেষকরা বলছেন, সৌদি আরবের এই পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো নারীর স্বাধীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের স্পষ্ট নিদর্শন। 

তারা বলছেন, এসব কেন্দ্র বন্ধ করে নারীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় ও সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। যাতে নির্যাতিত নারীরা দমনের শিকার না হয়ে সুরক্ষিত জীবন যাপন করতে পারে।

এক তরুণী জানান, তার বাবা তাকে যৌন নির্যাতনে বাধ্য করতে দার আল-রেয়ার ভয় দেখাতেন। ‘আমার কাছে তখন দুটোই ভয়াবহ ছিল বাড়িতে থেকে নির্যাতনের শিকার হওয়া, না হয় ওই পুনর্বাসন কেন্দ্রে যাওয়া।’ একজন নারীর উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, একটি নির্যাতিত মেয়েকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য এক নারীকে ছয় মাসের জেল দেওয়া হয়। সৌদি আইনে একজন নারী ‘বাড়ি থেকে পালিয়েছে’ এমন অভিযোগ থাকলে তাকে আশ্রয় দেওয়া অপরাধ।

‘যদি আপনার ভাই বা বাবা আপনাকে যৌন নির্যাতন করে বা গর্ভবতী করে ফেলে, তাহলে পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে আপনাকেই দার আল-রেয়াতে পাঠানো হবে।’ ২৫ বছর বয়সী আমিনা নামের এক তরুণী জানান, বাবা তাকে মারধর করার পর তিনি নিজেই বরাইদাহ শহরের এক পুনর্বাসনকেন্দ্রে আশ্রয় চান। কিন্তু সেখানকার পরিবেশ ছিল ‘জীর্ণ-পুরাতন, ভয়ানক’ এবং স্টাফরা ছিল ‘নির্দয় ও অমানবিক’। তাকে বলা হয়, অন্যদের অবস্থা নাকি আরো খারাপ তারা ‘শিকলে বাঁধা অবস্থায় বাড়িতে আটকে’ থাকেন।

এই প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো সৌদি সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে এবং নারীদের বিরুদ্ধে এই ধরনের নৃশংস আচরণ বন্ধ করতে আহ্বান জানাচ্ছে। 

আরটিভি/এসকে 

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন
Advertisement
Advertisement

Loading...


© All Rights Reserved 2016-2025 | RTV Online | It is illegal to use contents, pictures, and videos of this website without authority's permission