ঢাকাবুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, আরটিভি নিউজ

মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫ , ১১:২৬ এএম


loading/img
ছবি: সংগৃহীত

মধ্যপ্রাচ্যে চলমান ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে ইরানের দুই ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন ও রাশিয়া। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক জরুরি বৈঠকে ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার নিন্দা জানিয়ে তারা যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। পাশাপাশি, সংঘাতের ভয়াবহ আন্তর্জাতিক প্রভাব নিয়েও সতর্ক করেছে দেশ দুটি।

বিজ্ঞাপন

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুও জিয়াকুন বলেন, ‘সব পক্ষকে আমরা আহ্বান জানাই, যেন অবিলম্বে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় যা উত্তেজনা হ্রাস করবে এবং এই অঞ্চলকে আর বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেবে না। আলোচনার মাধ্যমেই সমাধানের পথ তৈরি করতে হবে।’

চীন পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে, তারা ইরানের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা লঙ্ঘনের বিপক্ষে। একইসঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে যে কোনো সংঘাত বা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে এমন পদক্ষেপেরও বিরোধিতা করে তারা।

বিজ্ঞাপন

রাশিয়াও একই সুরে কথা বলেছে। জাতিসংঘে দেওয়া এক বিবৃতিতে মস্কো বলেছে, তারা ইরানকে যুক্ত করে যে কোনো সামরিক উত্তেজনা বাড়ানো বা আগ্রাসনের তীব্র বিরোধিতা করে এবং এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আলোচনাকেই একমাত্র পথ হিসেবে বিবেচনা করে।

হরমুজ প্রণালি বন্ধের ইরানি হুমকির প্রশ্নে চীনের পক্ষ থেকে সরাসরি সমর্থন জানানো হয়নি। চীনা মুখপাত্র শুধু বলেছেন, ‘এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ুক, তা কেউই চায় না।’

চীন ও রাশিয়া উভয়েই কূটনৈতিক সমাধানকে অগ্রাধিকার দিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে উত্তেজনা নিরসনের ওপর জোর দিয়েছে। ইসরায়েল ও ইরানে অবস্থিত চীনা দূতাবাসে হামলার পর নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করেছে বেইজিং। চীনা কর্তৃপক্ষ দেশটির নাগরিকদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে। এর আগে, ২০২৪ সালের অক্টোবরেও একই রকম অবস্থান নিয়েছিল চীন, যখন মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল।

বিজ্ঞাপন

সেই সময় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াংই, ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজকে স্পষ্টভাবে বলেন, দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ ও অস্থিরতা এই অঞ্চলের কোনো পক্ষের জন্যই লাভজনক নয়। তিনি সব পক্ষকে দায়িত্বশীল আচরণের আহ্বান জানান, যাতে পরিস্থিতি আরও অবনতি না ঘটে।

বিজ্ঞাপন

একই মাসে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির সঙ্গে এক বৈঠকে ওয়াং ই জানান, চীন সংঘাত নয়, বরং শান্তিপূর্ণ সমাধানে বিশ্বাসী। তিনি বলেন, চীন যেকোনো সামরিক পদক্ষেপ ও উত্তেজনার বিপক্ষে অবস্থান নেয় এবং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে প্রস্তুত।

এছাড়া, জাতিসংঘে চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি ফু কং ইসরায়েলের কার্যক্রমের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি ইরানে ইসরায়েলি হামলা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ইসরায়েলকে উসকানিমূলক তৎপরতা বন্ধের আহ্বান জানান।

সবশেষে, ২০২৫ সালের ১২ জুন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA)-এর বোর্ড অব গভর্নরস-এর ভোটাভুটিতে ইরানের বিরুদ্ধে প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় চীন ও রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির আনা প্রস্তাবটিতে ইরানকে পারমাণবিক প্রতিশ্রুতি ভাঙার অভিযোগ করা হয়। চীনের প্রতিনিধি লি সং বলেন, সমস্যার সমাধান জোরজবরদস্তি, নিষেধাজ্ঞা বা সামরিক চাপ দিয়ে নয়, বরং সংলাপ ও কূটনীতির মাধ্যমে হওয়া উচিত। তিনি ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সরে যাওয়াকেই বর্তমান সংকটের মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।

ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষ নিয়ে চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সিনা ওয়েইবোতে শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনা। ১৬ জুন সকাল ৮টা ৩৯ মিনিটে একটি হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিং তালিকার শীর্ষে উঠে আসে, যা দেখা হয়েছে ১৬ কোটি বার এবং এতে মন্তব্য পড়ে ৭৬ হাজারের বেশি। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন চ্যানেল সিসিটিভি এই সংঘাতের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো সরাসরি ওয়েইবোতে সম্প্রচার করে।

ওয়েইবোতে প্রভাবশালী ভাষ্যকার হু শিজিন লিখেছেন, ইরান যেন এখন ছিদ্রপূর্ণ এক দেশ, যেখানে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ অত্যন্ত নির্ভুলভাবে বিপ্লবী গার্ডসের কমান্ডার মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি এবং দু’জন পারমাণবিক বিজ্ঞানীর অবস্থান শনাক্ত করে হামলা চালিয়েছে। তিনি এ ঘটনাকে সরাসরি সন্ত্রাসবাদ বলে আখ্যায়িত করেন।

আরেক ভাষ্যকার শেন ই প্রশ্ন তোলেন, ইরানের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ এত সহজ কীভাবে সম্ভব হলো? তার সন্দেহ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দুতে হয়তো কেউ ইসরায়েলের সঙ্গে আঁতাত করছে এবং বিদেশি শক্তির সহায়তায় অভ্যন্তরীণভাবে অভিযান চালাচ্ছে।

একটি পোস্টে হু শিজিন লিখেছেন, ইরানের কঠোর কথার বিপরীতে বাস্তবিক প্রতিরোধহীনতা একটি দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি—যা চীনের জন্যও একটি শিক্ষা। তার মতে, শুধু শক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবস্থান তৈরি করা সম্ভব, কথায় নয়।

জাতীয়তাবাদী ব্লগার জিভো শিয়াশি বলেন, ইসরায়েলের আচরণ প্রমাণ করে যে নতি স্বীকার করলেও প্রতিপক্ষ ক্ষমা করে না। তিনি লেখেন, ‘এই জঙ্গলসদৃশ বিশ্বে টিকে থাকতে হলে শক্তি দেখাতে হয়। জয়ী হলে তুমিই ঠিক।’

এদিকে, রাজনৈতিক ভাষ্যকার লি শাওসিয়ান সিসিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ট্রাম্প ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক ফোনালাপ ইসরায়েলকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলার পরোক্ষ অনুমোদন দেওয়ার ইঙ্গিত দেয়।

ইরান-ইসরায়েল সাম্প্রতিক সংঘর্ষ নিয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম তুলনামূলকভাবে সংযত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত দুটি প্রধান টিভি চ্যানেল—চ্যানেল ওয়ান এবং রাশিয়া চ্যানেল ১—সংঘর্ষের খবর প্রচার করলেও তা সীমিত মাত্রায় এবং নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছে। তারা জানিয়েছে, ইসরায়েল শুধু পারমাণবিক স্থাপনা নয়, আবাসিক এলাকাগুলোকেও লক্ষ্যবস্তু করেছে। বিশেষ করে রাশিয়া চ্যানেল ১ বলেছে, এই প্রথমবার আবাসিক এলাকায় সরাসরি হামলা চালানো হয়েছে, যদিও সেগুলোর কাছাকাছি ইরানের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা অবস্থান করছিলেন।

টেলিগ্রামে জনপ্রিয় রাজনৈতিক বিশ্লেষণমূলক চ্যানেল জাপিসকি ভেটেরান ব্যঙ্গ করে ধ্বংস হওয়া বেসামরিক ভবন ও যানবাহনের ছবি দিয়ে লিখেছে, ‘এইগুলোই বুঝি সেই ‘পারমাণবিক স্থাপনা’ যার কথা বলা হচ্ছিল।’  
এদিকে ইউরি পডোলিয়াকা নামের এক ভাষ্যকার ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় আছেন বলে জানান, তবে তার বিশ্বাস, তারা কিছুই বলবে না।

রাশিয়ার প্রো-ক্রেমলিন বিশ্লেষক ও সাবেক সংসদ সদস্য সার্গেই মার্কভ মনে করেন, মস্কো সরাসরি এই সংঘাতে জড়াবে না। তিনি বলেন, ‘ইরান আমাদের বন্ধু, রাজনৈতিক মিত্র—কিন্তু সামরিক মিত্র নয়।’ তার মতে, রাশিয়ার ভূমিকা সীমাবদ্ধ থাকবে কূটনৈতিক সমাধানে মধ্যস্থতার দিকেই, তবে তা এখনই নয়।

চ্যানেল ওয়ানের সঞ্চালক আরতিয়ম শেইনিনও জানা, সবকিছুই অনিশ্চিত। একইসঙ্গে ইউক্রেন থেকে মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল বিমান প্রতিরক্ষা সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য দ্বিমুখী নীতির ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন।

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে রাশিয়া ও ইরান একটি কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করলেও, রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই রুডেনকো এপ্রিল মাসে পরিষ্কার করে দেন ইরান যুদ্ধে জড়ালেও রাশিয়া সামরিকভাবে সহায়তা করতে বাধ্য নয়।

প্রসঙ্গত, গত ১২ জুন দিনগত রাত হঠাৎ ইরানে বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামের এই অভিযানে রাজধানী তেহরানসহ ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা, পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র ও আবাসিক স্থাপনায় হামলা চালায় ইহুদিবাদী সেনারা।

সেই থেকে চলমান সংঘাতে এখন পর্যন্ত উভয় দেশের অনেকে নিহত ও আহত হলেও এই সহিংস পরিস্থিতি থামাতে এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।


আরটিভি/এসকে -টি

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন
Advertisement
Advertisement

Loading...


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |