গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকেই ইসরায়েলের নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, সেটি কারোরই অজানা নয়। যদিও বিষয়টি এখনও প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি দেশটি। উল্টো ইরান ‘পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি রয়েছে’ দাবি করে দেশটির ওপর হামলা শুরু করে ইসরায়েল।
শান্তি ও নিরাপত্তা বিশেষক স্পেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডেলাস সেন্টার ফর পিস স্টাডিজের গবেষক ও পদার্থবিজ্ঞানী জেভিয়ার বোহিগাস বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলই একমাত্র দেশ, যার কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। খবর বিবিসির
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইরানসহ অন্যান্য দেশগুলো পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে (এনপিটি) স্বাক্ষর করলেও ইসরায়েল এখনও সই করেনি। ফলে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মতো একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর আইএইএ-কে তাদের সম্ভাব্য পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করতে দিতে তারা বাধ্য নয়।
যদিও ইসরায়েল নিজে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার একজন সদস্য। যেহেতু দেশটি পরিদর্শনের অনুমতি দেয় না, সেকারণে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে খুব একটা তথ্যও পাওয়া যায় না। যতটুকু তথ্য জানা যায়, সেগুলো মূলত ফাঁস হওয়া তথ্য, মার্কিন প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি বিভাগের প্রতিবেদন এবং পারমাণবিক কর্মসূচি পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর গবেষণা থেকে প্রাপ্ত।
ষাটের দশকে এসে ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়টি প্রথমবার স্বীকার করেন।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রকাশিত গোপন নথি থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালের মধ্যেই দেশটির সরকার নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, ইসরায়েলের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
এরপর আশির দশকে এসে পরমাণু প্রকৌশলী মোর্দেচাই ভানুনু ইসরায়েল সরকারের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয় আবারও সামনে আনেন। তিনি ১৯৮৬ সালে ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য সানডে টাইমসকে জানান, ইসরায়েলের পারমাণবিক কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। যদিও এই তথ্য প্রকাশ করার জন্য তাকে অনেক বছর জেলও খাটতে হয়েছে।
সেই সময় মোর্দেচাই ভানুনু জানিয়েছিলেন, ইসরায়েলের কাছে আনুমানিক ১০০ থেকে ২০০টি পারমাণবিক ‘ওয়ারহেড’ ছিল। বোমার সামনের যে অংশে মূলত বিস্ফোরক রাখা থাকে, সেটি ওয়ারহেড নামে পরিচিত। যদিও এত ‘ওয়ারহেড’ থাকার দাবিটি পরমাণু অস্ত্র পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলো মানছে না।
সুইডেনভিত্তিক পরমাণু অস্ত্র পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, বর্তমানে ইসরায়েলের কাছে ৯০টির মতো ওয়ারহেড থাকতে পারে। এসব ওয়ারহেড তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় প্লুটোনিয়াম দক্ষিণ ইসরায়েলের ডিমোনা শহরের কাছে অবস্থিত নেগেভ পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রের চুল্লিতে উৎপাদিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
যদিও ইসরায়েলের সরকার দাবি করে আসছে, পরমাণু চুল্লিটির উৎপাদন সক্ষমতা মাত্র ২৬ মেগাওয়াট। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, চুল্লিটির উৎপাদন সক্ষমতা আরও অনেক বেশি।
ইসরায়েলের অন্যান্য পারমাণবিক স্থাপনার মতো এই চুল্লিটিরও আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) নজরদারির বাইরে রয়েছে। ফলে সেটির অপব্যবহার হচ্ছে কী-না এবং পারমাণবিক কর্মসূচি কতটা শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটি স্বাধীনভাবে যাচাই করার সুযোগ নেই।
উল্লেখ্য, কোনোপ্রকার উস্কানি ছাড়াই গত ১৩ জুন দিনগত রাত হঠাৎ ইরানে হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামের এই অভিযানে রাজধানী তেহরানসহ ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা, পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র ও আবাসিক স্থাপনায় হামলা চালায় ইহুদিবাদী সেনারা।
হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি, দেশটির ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান কমান্ডার হোসেইন সালামি, খাতাম আল-আনবিয়া সদরদপ্তরের কমান্ডার ও বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মেজর জেনারেল গোলাম আলি রশিদ ও দশজন পরমাণু বিজ্ঞানীসহ ৪০০ এর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
ইসরায়েলের হামলার পর পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে শুক্রবার রাতে ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস-৩ নামে’ অভিযান শুরু করে ইরান। তেহরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ভেদ করে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানছে। এতে হতাহত কম হলেও ইসরায়েলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। চলমান এই সংঘাতের মধ্যে ২১ জুন দিনগত রাতে ইরানের ফোরদো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান—তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এতে এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আরটিভি/আরএ/এআর