ঢাকারোববার, ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২

যেভাবে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হয়ে উঠলেন আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, আরটিভি নিউজ 

বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫ , ০৮:৫২ পিএম


loading/img
ছবি : সংগৃহীত

আধুনিক ইরানের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিক ও ধর্মীয় নেতার নাম আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। ১৯৮৯ সালে সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আজ পর্যন্ত তিনি ইরানের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও কূটনৈতিক নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রে রয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দুজনেই ইরানের এই সর্বোচ্চ নেতাকে সরাসরি লক্ষ্যবস্তু করার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প খামেনিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ইরানের কথিত সর্বোচ্চ নেতা কোথায় লুকিয়েছেন সেটি তার জানা, কিন্তু এখনি তাকে মারা হবে না।

বিজ্ঞাপন

প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান নয়, আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি কেন আমেরিকা বা ইসরায়েলের টার্গেটে সেই প্রশ্নও সামনে আসছে।

ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার শাসনের এই ব্যবস্থা চালু হয় ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে। একটি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে রেজা শাহ পাহলভীর রাজতন্ত্রকে উৎখাত করা হয়। তাকে উৎখাতের পর ইরানে ধর্মীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

এরপর দেশটি দুজন সুপ্রিম লিডার বা সর্বোচ্চ নেতা পেয়েছে। তাদের পদবী হিসেবে আয়াতুল্লাহ ব্যবহার করা হয়, শিয়া ধর্মাবলম্বীদের কাছে যার অর্থ সিনিয়র ধর্মীয় নেতা।

বিজ্ঞাপন

সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এখন দেশটির সামরিক বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ। এ ছাড়া দেশের সব বড় বা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে তার সম্মতি দরকার হয়। এমনকি ইরান পারমাণবিক ক্ষমতার অধিকারী হবে কিনা অথবা জাতিসংঘের আণবিক শক্তি সংস্থাকে সহযোগিতা করবে কি না, এসবের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তিনি দেন।

বিজ্ঞাপন

আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি কে

আলী খামেনির জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৯ এপ্রিল ইরানের মাশহাদ শহরের এক ধর্মীয় পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং মাশহাদ ও ইরাকের পবিত্র নগরী নাজাফের বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষালাভ করেন। পরে তিনি ইরানের কওম শহরে স্থায়ী হন এবং আয়াতুল্লাহ হুসাইন বুরুজেরদি ও আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির শিষ্যত্বে অধ্যয়ন করেন।

ষাট ও সত্তরের দশকে তিনি শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনবিরোধী গোপন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এর ফলে বহুবার গ্রেপ্তার হন ও শাহের গোপন পুলিশ সংস্থা সাভাকের হাতে নির্যাতিত হন।

বিপ্লব-পরবর্তী উত্থান

১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে শাহের পতনের পর ইরানে নতুন রাজনৈতিক কাঠামো গঠিত হয়। এই সময় খামেনি দ্রুত নতুন শাসনব্যবস্থার অভ্যন্তরে উচ্চপর্যায়ের ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি ইসলামী বিপ্লবী পরিষদের সদস্য, উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য ছিলেন।

১৯৮১ সালে একটি হত্যাচেষ্টায় গুরুতর আহত হন। একটি মসজিদে বক্তৃতাকালে টেপ রেকর্ডারে লুকানো বোমা বিস্ফোরণে তার ডান হাত স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যায়।

একই বছরের আগস্টে ইরানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলি রাজায়ী ও প্রধানমন্ত্রী জাভাদ বাহোনার নিহত হলে খামেনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেন এবং নিরঙ্কুশভাবে জয়লাভ করেন।

সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্ব গ্রহণ

১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির মৃত্যু ইরানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। তার উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত আয়াতুল্লাহ মনতাজেরিকে শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হয়। ফলে এক নতুন পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচিত হন খামেনি, তিনি ওই সময় ছিলেন কেবল ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ পদমর্যাদার একজন মধ্যপন্থি আলেম। নিজেই ওই সময় বলেছিলেন, ‘আমি একজন ক্ষুদ্র মৌলভী, এই পদে নিজেকে উপযুক্ত মনে করি না।’

তবে সংবিধানে পরিবর্তন এনে শীর্ষ ধর্মীয় মর্যাদার চেয়ে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সময়োপযোগী দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেই পরিবর্তনের মাধ্যমে খামেনির উত্থানকে বৈধতা দেওয়া হয়।

সংকট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা

২০০৯ সালে আহমাদিনেজাদের বিতর্কিত পুনঃ-নির্বাচন ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর সবচেয়ে বড় আন্দোলনের জন্ম দেয়।

সর্বোচ্চ নেতা খামেনি ওই নির্বাচনের ফলাফল বৈধ বলে ঘোষণা দেন এবং তীব্র আন্দোলন দমনে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন। এই দমন অভিযানে অনেক বিরোধী কর্মী নিহত হন, গ্রেফতার হন হাজার হাজার মানুষ।

২০১৩ সালে ইরানের উদারপন্থী নেতা হাসান রুহানি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং বিশ্বশক্তিগুলোর সাথে ঐতিহাসিক পরমাণু চুক্তি করেন। এই চুক্তি খামেনির সম্মতিতেই সম্পন্ন হয়। তবে রুহানির নাগরিক অধিকার প্রসার ও অর্থনৈতিক সংস্কার উদ্যোগে বাধা দেন সর্বোচ্চ নেতা খামেনি।

২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে এসে ইরানের ওপর আবারও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে সাধারণ ইরানিদের অর্থনৈতিক দুর্দশা আরও বাড়তে শুরু করে। রুহানি সেই চাপ সামলাতে ব্যর্থ হন এবং ২০১৯ সালের নভেম্বরে ব্যাপক গণবিক্ষোভ শুরু হয়।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে ইরাকের মাটিতে একটি ড্রোন হামলায় যুক্তরাষ্ট্র ইরানের প্রভাবশালী জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা করে। সোলেইমানি আয়াতুল্লাহ খামেনির ঘনিষ্ঠ মিত্র ও ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। এই হামলার পর খামেনি সোলেইমানি হত্যার প্রতিশোধের ঘোষণা দেন। ইরাকের দুটি মার্কিন ঘাটিতে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান।

পরে তিনি বলেছিলেন, ইরাকে অবস্থিত দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের প্রতিশোধমূলক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ছিল 'আমেরিকার গালে চপেটাঘাত'।

খামেনি তখন জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই ধরনের সামরিক পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়।’

শীর্ষ নেতা হিসেবে আয়াতুল্লাহ খামেনি বহুবারই ইসরায়েল রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার আহ্বান জানিয়েছেন।

২০১৮ সালে তিনি ইসরায়েলকে ‘একটি ক্যানসার আক্রান্ত টিউমার’ আখ্যা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইসরায়েলকে মুছে ফেলার ফেলার হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

তিনি প্রকাশ্যে হলোকাস্ট বা ‘ইহুদি গণহত্যা’ আদৌ ঘটেছিল কি না, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন।

২০১৪ সালে তার টুইটার অ্যাকাউন্টে উদ্ধৃত একটি বার্তায় বলা হয়েছিল: হলোকাস্ট এমন এক ঘটনা যার বাস্তবতা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে, আর যদি ঘটেও থাকে, সেটা কীভাবে ঘটেছিল, তাও স্পষ্ট নয়।

২০২০ সালে, আয়াতুল্লাহ খামেনি এবং ইরানের সরকার দুটি বড় সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল।

প্রথম সংকটটি শুরু হয় ওই বছর আটই জানুয়ারি। তখন ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি ভুল করে ইউক্রেন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী বিমান তেহরানের কাছে ভূপাতিত করে। এতে বিমানে থাকা ১৭৬ জন যাত্রীর সবাই নিহত হন। যাদের অনেকেই ছিলেন ইরানি নাগরিক।

ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার ফলে ইরানের ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। কট্টরপন্থী সংবাদপত্রগুলি পদত্যাগের দাবি জানায় এবং সরকারবিরোধী বিক্ষোভের নতুন ঢেউ ওঠে। ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী তাদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলির ব্যবহারও করে বলে অভিযোগ ছিল।

সে সময় শুক্রবারের জুমার নামাজের বিরল এক খুতবায় আয়াতুল্লাহ খামেনি বলেন, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় তিনি মর্মাহত। তবে তিনি তখন সামরিক বাহিনীর পক্ষই নিয়েছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, ইরানের শত্রুরা এই ট্র্যাজেডিকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে।

ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে, ইরানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ছড়িয়ে পড়ে। আয়াতুল্লাহ খামেনি প্রথমে করোনাভাইরাসের হুমকিকে খাটো করে দেখেছিলেন, বলেছিলেন যে ইরানের শত্রুরা এটিকে ভয় দেখানোর কৌশল হিসেবে অতিরঞ্জিত করছে।

উত্তরসূরি কে হবেন

৮৫ বছর বয়সী খামেনি শারীরিক অবস্থা ও বয়স বিবেচনায় তার উত্তরসূরি নিয়ে আলোচনা তীব্রতর হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন তার ছেলে মোজতবা খামেনি উত্তরসূরি হতে পারেন। আবার কেউ কেউ সদ্য প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির দিকেও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তবে রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্যে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে।

আরটিভি/একে -টি

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |