কেন ভারত থেকে ম্যালেরিয়ার ওষুধ নিতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র?
করোনাভাইরাস ঠেকাতে ভারতের কাছে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হওয়া হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন চেয়ে পাঠিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শুধু তাই নয়, ওষুধ না মিললে ‘ফল’ ভালো হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে কেবল ট্রাম্পই নন, করোনার এই ‘মিরাকল’ ওষুধের রপ্তানিতে ভারতকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে অনুরোধ করেছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারোও। খবর আনন্দবাজারের।
কিন্তু কেন এত চাহিদা? করোনা প্রতিরোধে এই হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কি আদৌ ‘গেম চেঞ্জার’? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দীর মতে, না। ‘গেম চেঞ্জার’ বলা যায় না একেবারেই। সারা বিশ্বেই করোনা আক্রান্ত দেশগুলোতে এই ওষুধ নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে। কোথাও ভালো কাজ দিচ্ছে, আবার কোথাও এই ওষুধ ডেকে আনছে অন্য রোগ। যে ওষুধ এখনও নির্দিষ্ট কোনও নিয়ম মেনে একই রকম ফল সারা বিশ্বে দেখাচ্ছে না, তাকে কী করে গেম চেঞ্জার বলি! বরং যুক্তরাষ্ট্র এই পরিস্থিতিতে কিছুটা খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছে, সেটা খুবই স্বাভাবিক। তাই তাদের দেশে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কিছুটা ভালো কাজ দিয়েছে বলে, সেটার ওপরেই মার্কিনিদের নির্ভরশীলতা বাড়ছে।
হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনকে গেম চেঞ্জার বলতে নারাজ করোনা-চিকিৎসায় যুক্ত থাকা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামীও। তার মতে, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কতটা কাজ করবে তা আমরা নিজেরাই জানি না। কন্ট্রোলড ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল না হলে তা জানা সম্ভবও নয়। বহু ক্ষেত্রে ওষুধ খাওয়ার পরেও রোগ থেকে গেছে, কোথাও সেরেও গেছে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)-এর ন্যাশনাল টাস্কফোর্স মার্চেই এক বিজ্ঞপ্তিতে করোনা মোকাবিলায় কোনও কোনও ক্ষেত্রে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। আমাদের দেশেও এর প্রয়োগ চলছে। এটা আদৌ এখানে কাজ দিচ্ছে কিনা তা বলার মতো সময় এখনও আসেনি।
এই হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কী?
সুবর্ণ গোস্বামী বলেন, ক্লোরোকুইন ফসফেট ম্যালেরিয়া সারানোর ওষুধ। সিঙ্কোনা গাছ থেকে এর মূল উপাদান পাওয়া যায়। ক্লোরোকুইনের হাইড্রক্সিলেটেড সল্টকে বলে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। ভারত সরকার একে প্রোফাইল্যাক্টিক বা রোগ প্রতিরোধে সাহায্যকারী ড্রাগ হিসেবে ব্যবহার করার অনুমোদনও দিয়েছে। তবে এই ওষুধ যে সফলভাবে কাজ করছে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
ভারতে কি এটি প্রচুর উৎপন্ন হয়?
বায়োকেমিস্ট্রির গবেষক সৌরভবিকাশ রুদ্রর মতে, এই ওষুধ মূলত ম্যালেরিয়াপ্রবণ দেশগুলোতেই পাওয়া যায়। ভারত ক্লোরোকুইন তৈরিতে বিশ্বের প্রথম সারিতে রয়েছে। এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্লোরোকুইন উৎপন্ন হয় এখানেই। এর আগে আফ্রিকায় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেলেও তারা এখন ক্লোরোকুইনে ‘রেজিস্ট্যান্স’ হয়ে উঠেছে, অর্থাৎ ক্লোরোকুইনের সঙ্গে ম্যালেরিয়ার জীবাণু ভাব করে নিয়েছে। তাই ক্লোরোকুইনে আর সেভাবে কাজ হয় না সেখানে।
তিনি বলেন, বর্তমানে তাই আফ্রিকা সিঙ্কোনা চাষ অনেক কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ভারতে চিত্রটা অন্য। এখানে সিঙ্কোনা চাষ ও ক্লোরোকুইনের উৎপাদন ও জোগান অনেক বেশি। কারণ ম্যালেরিয়াও অনেক বেশি। তাই সারা বিশ্বই ভারতের দিকে তাকিয়ে এই হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের জন্য। ভারত ইতোমধ্যেই ১০ কোটি হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ট্যাবলেট ‘ইপকা ল্যাবরেটরিজ’ ও ‘জিডাস ক্যাডিলা’-কে তৈরি করতে নির্দেশ দিয়েছে।
তবে চিকিৎসকদের একদল এই ওষুধটিকে মোটেও ‘নিরাপদ’ বলতে রাজি নন। তাদের মতে, এই ওষুধের প্রচুর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে।
কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া?
আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ-এর কর্মকর্তা অ্যান্টনি ফৌচি একেবারেই এই ওষুধ সুস্থ মানুষকে দেয়ার পক্ষপাতী নন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের দেয়ার ক্ষেত্রেও তার সংশয় আছে বলে জানান তিনি।
সম্প্রতি ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, কোভিড-১৯ ঠেকাতে কাজে লাগে জানা গেলেও যতক্ষণ না কনট্রোলড ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা হচ্ছে, নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না এই ওষুধ কতটা কার্যকর। বরং এর নানা রকমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভাবাচ্ছে চিকিৎসকদের।
বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ সুমিত সেনগুপ্তের মতে, এই ওষুধের প্রয়োগ সব শরীরের জন্য নয়। হৃদরোগীদের একটা শ্রেণির ক্ষেত্রে এই ওষুধ ‘কার্ডিয়াক অ্যারিদমিয়া’ নামের হৃদরোগ ডেকে আনে। বেশ কিছু সমস্যা— যেমন সোরিয়াসিস, পরফাইরিয়া, লিভারের অসুখ, অ্যালকোহলিজম ইত্যাদি থাকলে ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় বড় ক্ষতি হতে পারে।
এ/পি
মন্তব্য করুন