ডিপ্রেশন শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে হতাশার ভাবার্থ। শব্দটির সঙ্গে জুড়ে থাকে কিছু অমূলক-ভ্রান্ত ধারণা, গোঁড়ামি এবং ভয়। এতটাই ভয় যে, অভিভাবকদের অনেকেই মানতে চান না, শিশুদেরও ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, টিনএজার এবং প্রাক-টিন বা টুইনদেরও (দশ থেকে বারো বছর বয়সি) মানসিক অবসাদ হয়।
তবে অভিভাবকদের মধ্যে এখনও এই বিষয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। ‘আমার সন্তানের কেন এমন হল?’ সেই প্রশ্নের চেয়েও সন্তানের মনে কী চলছে, সেটা বোঝা অনেক বেশি জরুরি। এই কঠিন সত্যকে মেনে নিয়ে ছোটদের পাশে দাঁড়ানোই অভিভাবকদের আশু কর্তব্য।
ভারতের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রামের কথায়, ‘ডিপ্রেশন হলেই মানসিক পরিবর্তন ঘটবে, যা ব্যক্তির আচরণে ফুটে ওঠে। পরিবার, স্কুলে এবং বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে টিনএজারের আচরণে এই পরিবর্তন বিশেষ ভাবে চোখে পড়ে।’
ভারতের আরেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীর মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘যে কোনও বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে ডিপ্রেশনের ডায়াগনোসিস করা যায়। তবে শিশুদের অভিব্যক্তি খানিক আলাদা হয়। টিনএজ বয়সে শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে নানা পরিবর্তন দেখা যায়। তাই এই বয়সের ছেলেমেয়েরা সহজেই বেশি ভেঙে পড়ে।’
শিশুদের মানসিক অবসাদের লক্ষণ
গুটিয়ে নেওয়া
ডিপ্রেশনের অতি পরিচিত একটি লক্ষণ, নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া। যে বিষয়ে শিশু আগে আনন্দ পেত, সেগুলোতে আর আনন্দ পাচ্ছে না। বন্ধুদের দল থেকে নিজেকে আলাদা করে নেওয়া, বাড়িতে পরিবারের থেকে আলাদা থাকা—এমন লক্ষণ দেখা যায়।
আঁকড়ে থাকা
গুটিয়ে নেওয়া এবং আঁকড়ে থাকা—একই মানদণ্ডের যেন দুই প্রান্ত। মা-বাবা বা পরিবারের কাউকে অস্বাভাবিক ভাবে আঁকড়ে থাকাও অবসাদের লক্ষণ হতে পারে।
খাওয়া-ঘুমে সমস্যা
খেতে না চাওয়া, কম খাওয়া, অনিদ্রার নেপথ্যেও অবসাদ থাকতে পারে।
মুড সুইং
ঘন ঘন কাঁন্না করা, রেগে যাওয়া, অবাধ্য আচরণের (জিনিসপত্র ছোড়া, ভাঙচুর করা) মতো উপসর্গওদেখা যায়।
অমনোযোগিতা
পড়াশোনার ক্ষেত্রে মান নিম্নমুখী হতে পারে। স্কুলে যেতে না চাওয়া, পড়াশোনার সময়ে ভিডিও গেমে বুঁদ হয়ে থাকাও অবসাদের লক্ষণ হতে পারে। পড়াশোনা করতে যে মনোযোগের দরকার হয়, সেই পর্যায়ের মনোযোগ ভিডিও গেমে লাগে না। খানিকটা পলায়নপ্রবৃত্তিরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে এ ক্ষেত্রে।
মাদকাসক্তি এবং অন্য আসক্তি
আবীর মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘অবসাদের কারণ এবং তার ফল দুটোই হতে পারে আসক্তি।’ জয়রঞ্জন রামের কথায়, ‘মন কতটা খারাপ, বা মাদক-অ্যালকোহলে আদৌ মনখারাপ দূর হয় কি না, এমন পরীক্ষানিরীক্ষার দিকে ঝোঁক থাকে টিনএজারদের। অবসাদের নেপথ্যে এই ধরনের আসক্তির বড় ভূমিকা থাকে।’
নিজেকে আঘাত করা
আত্মহত্যার চেষ্টা না করলেও, ‘জীবন রেখে কী লাভ’, ‘বাঁচতে ইচ্ছে করে না’। এ জাতীয় কথা শুনলে সজাগ হতে হবে অভিভাবকদের। ব্লেড দিয়ে হাত কাটা বা নিজেকে আঘাত করার মতো প্রবণতা দেখা দিলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
মন খারাপ আর ডিপ্রেশন এক নয়। কিন্তু মনখারাপের পর্যায় যদি চলতেই থাকে, তখন তা নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে। ছেলে-মেয়ে ‘পাল্টে’ যাচ্ছে, এমন আশঙ্কা দানা বাঁধলেই, অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
অবসাদের কারণ
পড়াশোনায় ব্যর্থতা, মা-বাবার বকুনি, স্কুলে বা বন্ধুদের সঙ্গে কোনও অবাঞ্ছিত অভিজ্ঞতা, পারিবারিক অস্থিরতা, সম্পর্কে বিচ্ছেদ ইত্যাদি। প্রাপ্তবয়স্কদের মতো করে এই বিষয়গুলো সামলানোর ক্ষমতা থাকে না বলেই টিনএজারদের ভেঙেপড়ার প্রবণতাও হয় বেশি। এ ছাড়া পরিবারে যদি অবসাদের ইতিহাস থাকে, তবে সে পরিবারের ছোটদের মধ্যেও ডিপ্রেশনের প্রবণতা দেখা যায়।
এ সময় পেরেন্টিং
- জয়রঞ্জন রাম এবং আবীর মুখোপাধ্যায় দু’জনেই একমত— অবসাদে অভিভাবকদের সহমর্মী হতে হবে। ‘কেন’-র চেয়েও ‘কী’ হচ্ছে, সেটা বুঝতে হবে। কোনও রকম ভ্যালু জাজমেন্ট না করে বুঝতে হবে, শিশুর সমস্যার জায়গাগুলো।
- অভিভাবকদের অনেকেই হয়তো বলেন, ওকে তো সব রকম সুযোগ-সুবিধে দেওয়া হচ্ছে। তাহলে ডিপ্রেশনের কারণ কী? এই প্রশ্ন অমূলক, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
- সব সময়ে আগলে রাখা। ব্যর্থতাকে গ্রহণ করার মতো মানসিক জোর এবং বিচক্ষণতা যেন তাদের গড়ে ওঠে, ছোট বয়স থেকেই সে চেষ্টা করতে হবে। মা-বাবার সামর্থ্য বোঝারও প্রয়োজন রয়েছে সন্তানের।
- নিজের সন্তানকে অন্য কারও সঙ্গে তুলনা না করাই ভালো।
- আর পাঁচটি রোগের মতোই অবসাদ একটা রোগ। সেটা হলে সন্তানকে সেই রোগ কাটিয়ে উঠতে সব দিক দিয়ে সাহায্য করবেন মা-বাবা। নিজেদের অজান্তে আরও অন্ধকারের দিকে তাদের ঠেলে না দেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
সূত্র : আনন্দবাজার